গল্পের ভূত আমাদের মাথায় থাকে না, পাশে পাশে ঘুরে
দিনটাই এমন যে একটা প্রেম প্রেম ভাব আছে। এই দিনে এসে লেয়ারবাগের প্রেমিকা নিয়ে ভাবা বা আমাদের যাপিত জীবনের প্রেম নিয়ে ভাবতে গেলে নির্মোহ হওয়ার সুযোগ একটু কমই থাকে। তারপরও নির্মোহ হওয়ার ভান করি, দেখি কোথায় লেয়ারবাগ আর তার প্রেমিকা। খুঁজি, খুঁজতে গিয়ে এক অদ্ভুত সমীকরণ এসে সামনে দাঁড়ায়। আর আমাদের জীবনের গল্পকেও যদি আমরা একটা সিনেমার গল্প হিসেবে ভাবি তাহলে এই ক্লাইমেক্সের ফাঁকে অন্য গল্পও বলে নেওয়া উচিত। তাই একটু অন্য অবস্থান থেকে গল্পটা বলার চেষ্টা করি, দেখি কি দাঁড়ায়।
এইখানে একটা হিমু গাছ আছে, লোকে তার নাম জানে না
মূল রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা দূরে। বলতে গেলে শহরের বাইরে আরও একটি উপশহরের রাস্তার পাশে বসেছিলো তারা। হঠাৎই ঝুম বৃষ্টি টিনের চালে ঝমঝম শব্দের উপস্থিতি জানান দেয়। গরম গরম জিলিপি ভাজায় খাওয়ার পর হাতে থাকা মিষ্টির শিড়া চেটেপুটে শেষ করতে করতে কোন আচমটা টানে যেন হাত পকেটে চলে যায়। অন্যের পকেটে নয়, নিজেরই পকেটে। পকেট থেকে সাদা কাগজের ভাজ করা একটি চিঠি মেলে ধরে লেয়ারবাগ। বলে এ তার প্রেমিকার পাঠানো চিঠি। হ্যাঁ, এই উত্তরআধুনিক যুগে লেয়ারবাগের কাছে তার প্রেমিকার চিঠি একটা আস্ত মানুষের চেয়ে বেশী তরতাজা আর আরো বেশী প্রাণময় হয়ে ধরা দেয়। বিপরীতে বসে থাকা তার বন্ধুটির চোখে রাজ্যের কৌতুহল। সত্যিই কি লেয়ারবাগ তার কল্পনার রাজকন্যার কাছ থেকে পাওয়া চিঠিটি মেলে ধরলেন? তার চোখে মুখে এখনো অবিশ্বাস খেলা করে। কিন্তু লেয়ারবাগের প্রেমিকার চিঠি যে এখনো বাস্তব! যেই চিঠি কিনা প্রমাণ করে কালিদাসের ডাকে পাঠানো চিঠিতে এই যুগে আসা মানুষ লেয়ারবাগ। চিঠির শেষ লাইনে কি অদ্ভুত প্রেমের জন্ম দিয়ে বালিকা (আসলেই কি বালিকা? নাকি আর জন্মে সে আফ্রোদিতির কাছ থেকে পাওয়া বিশেষ আশির্বাদে নোমাসের কাছে সমর্পণ করছে তার প্রেম?) বলে, তোমাকে কি তুমি করে বলা যায়?
চিঠি একটি নৈশর্গিক মৃত্যুর নাম, আর তারে ভুলে থাকা কঠিন
সে এক যুগ ছিলো। নির্দিষ্ট স্থানে প্রেমিকা আসবে, বহু প্রতীক্ষার এই খবর অনেক সময় পাওয়া যেতো নির্ধারিত সময় চলে যাওয়ার পরে। আর এই আক্ষেপ বুকে চাপা দিতে হাতে পাওয়া যেতো তরিঘরি করে লেখা একটা চিঠি। দুনিয়া তো ডিজ্যুস হয়ে গেছে কতকাল। যেদিন থেকে দুই টাকায় কথার রাত্রী পোহাতো সেই ডিজ্যুস দুনিয়ায় এখনো বাহকের হাত ধরে গোপনে আসে প্রেমিকার চিঠি। লেয়ারবাগ ছাড়া আর কার আছে সে ভাগ্য?
উটকো একটা বাস কোত্থেকে যে হাওয়ার মতো এসে উড়ে চলে যায়…
কিছুটা ঈর্ষা তোমার প্রেমিকারে নিয়া। তার কিছুটা সংগত কারণও আছে। সেই কথা বলতে গেলে অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু শুরুটা যে খুব একটা দুর্বল তা বলতে পারি না। তবুও বলি, গত পরশু হঠাৎ খবর পাওয়া গেলো, প্রিয় বন্ধুটির দীর্ঘদিনের প্রেমিকা তাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদেছিলো। বলেছিলো, তুমি আমার বিয়েতে এসো না। আর্ন্তজালের দুনিয়ায় তাই হাস্যোজ্জল একটা বিয়ের ছবি দেখে বন্ধুর জন্য কিছুটা মন আমারো কেঁদেছিলো। এইসব মেকি সম্পর্কের দিনগুলোতে আমরা যে একটা পারস্পরিক সৌহার্দ্যের স্বপ্নে বিভোর জীবন চেয়েছিলাম তার কথা মনে পড়েই একা একা ভেসেছিলাম হাহাকারের সমুদ্রে। বন্ধুরে, এইসব তো আমাদের জন্যই। এ ঘটনারও উল্টোপিঠে লেখা আছে আরও এক আক্ষেপের নাম। সেখানেও গল্প ত্রিভুজ প্রেমের। কিন্তু এই প্রেম ও এইসব মায়াময় পৃথিবী থেকে কিছুটা দূরে, বা তারও চেয়ে বহুদূরে এক অদ্ভুত পৃথিবী গড়ে যে বসে আছি আমি। সেই পৃথিবীর খবর কি তুই জানিস? না জানলেও জেনে রাখ, এইখানেই প্রেম করে লেয়ারবাগ, একটা বায়বীয় জীবনের চেয়ে আরও দৃঢ় স্বপ্নের কথা বলবো বলে সেখানে প্রতিদিনই নতুন গল্প আসে। আর সেই গল্পেরই একজন চরিত্র লেয়ারবাগের প্রেমিকা।
একটা ধূসর সূর্যের স্বপ্নের কথা তার জন্য
আমরা এখন কিছুটা ফ্ল্যাশব্যাক আর কিছুটা স্বপ্ন দৃশ্যের ভেতর। তার আগে যখন স্বপ্ন আর বাস্তবের ঘোর ছিলো না, এই বৃষ্টিবেলায় মুঠোফোনে তার বার্তা আসে “চলো সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে যাই, অন্ধকারে খালি পায়ে চলি আর বলি আমরা দু’জন সাইকেল হিমু”। খিকজ! এমন করে কি বলতে হয় বোকা? তুই বেটা জানিস না, হিমু-রা নিজেদের নাম বলে না। নগরের সড়ক দ্বীপগুলোতে দাঁড়িয়ে পাখিরা তার নাম প্রচার করে। শহরের এইসব বোকা বোকা নাগরিকরা হিমুর নাম জানতে জানতে জেনে যায় সড়ক দ্বীপগুলোতে বাস করা পাখিদের ঠিকানা। আর ঐ দিকে বালিকা কি মধুর হাসি দেয়। মায়াভরা হাসি। লাখ টাকা দিয়াও তুমি এই হাসি পাবা না। তার হাসির কথা বলতে বলতে আমার ঘুম পায়। ঘুম ভেঙে তাকিয়ে দেখি আমিও এক শিউলীবনে ঘুরে বেড়াচ্ছি। চারপাশের কাদামাটির সড়ক জুড়ে অজস্র শিউলীফুল। যেন ফুলের পাটি বিছিয়ে বসে আছে কবিয়াল। ঘুম ভাঙলেই শুরু হবে গান। অথচ শিউলীমালা এইসব জানে না। নোমাস, এইসব আসলে একটা প্রতিবাস্তবের চিহ্ন। আমরা যখন একটা একটা করে এইসব দেয়াল ভেঙে নতুন দুনিয়া বানাবো, তখন সে কি দূর থেকে দেখবে? নাকি সেও হবে সৈনিক?
চলো ভুল ভাঙা রাস্তার নাম বলি গন্তব্য
সেদিন কে যেন পেছন থেকে নাম ধরে ডাকলো। পেছনে তাকালে কোনও সুইডিশ তরুনীর দেখা পাই না। দেখা পাইনা কোনও সলাজ চোখ নিয়ে অপেক্ষায় থাকা রমনীর। অথচ কি দারুণ মৃত্যুগন্ধী সময় ছিলো জীবনে, তা তুমি জানো লেয়ারবাগ। তোমার প্রেমিকা সেইসব দিনের গভীর থেকে উঠে আসা কেবল একটা রহস্যের নাম ছিলো না। ছিলো আমাদের জীন থেকে বেড়িয়ে আসা জীবন রহস্যের মতো একটা মুখ অথবা সত্যিই সে একটা মিথ। কিন্তু তুমি আর তোমার সেই ডাকপিয়ন বন্ধুটি কখনো কি গুনে দেখেছো এইসব করতে গিয়ে কতটা ছবির মতো হারিয়ে গেছে তোমাদের হৃদয়? ভুলে যাও এইসব অস্পৃশ্য বেদনাবোধ। চোখ মেলে তাকালেই তুমি দেখতে পাবে একটা সবুজ সড়ক পেরিয়ে গেছে শহর বন্দর গ্রাম জনপদ। দূরে কোনও এক অশোক গাছের ছায়ায় পিড়া পেতে বসে আছে নরসুন্দর। একটি বালক ঘাড় গুঁজে নিজেকে সাফ-সুতরো করে নিচ্ছে। গাছের শাখায় বসে কিচিরমিচির করছে পাখিরা। এইবার চোখ মেলে তাকাও। দেখো কি সবুজ আর আশ্রয়ের ছায়া হয়ে গেছে তোমার প্রেমিকার চোখ, দেখতে পাচ্ছো লেয়ারবাগ?
আমি নই বলো তুমি, তুমি নও বল আমি
এখনো দ্বিধার সড়ক বড় বেশী বন্ধুর। তোমার কাছে তাই একটা নিয়োগ পত্র এসেছে দেখো। ভেতরে পদবীর স্থলে লেখা হাওয়া ঘরের তত্ত্বাবধায়ক। হ্যাঁ বন্ধু, এই হাওয়া ঘরই তোমার আমার ঠিকানা। নীল খামে ভরা ঐ চিঠি পাঠিয়েছে স্বয়ং জিউস। সেও আসলে পূর্ব জন্মে তোমার আমার যমজ ভাই ছিলো কিনা! তাকে বলে দাও, উত্তরের কোনও শেষ নেই। ডাক পিয়নের কাছ থেকে তুমি বুঝে নিয়েছো হাওয়া ঘরের দায়িত্ব। যার ভেতর রাজকন্যার মতো দেখতে একজন মানুষ রয়েছে। সেই মুখ কেবল মিথের কাছে আটকে থাকা কোনও দেবী নয় লেয়ারবাগ, সে তোমার প্রেমিকা।
--
আর্টওয়ার্কসঃ Monica Ramos, Jason deCaires Taylor
আর্টওয়ার্কসঃ Monica Ramos, Jason deCaires Taylor