গত ২২ জানুয়ারি ছিলো প্রিয় ব্যান্ড মেঘদলের
এক যুগ পূর্তি। সেই দিনের বারো বছর আগে প্রতিষ্ঠা পাইছিলো এক বাংলা ব্যান্ড। যার নাম
‘মেঘদল’। তো প্রিয় ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠার যুগপূর্তিতে
ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলে নিচে আইসা সাইয়েদ জামিল কমেন্ট করে “‘মেঘদল’-টা কী জিনিসরে
কমল?” আমি কোনও উত্তর দেই নাই। কারণ, আমার ধারণা জামিল খুব ভালো
করেই জানে এইটা কি জিনিস। তাই হয়তো তার অন্য কোনও চিন্তা আছে প্রশ্নের পেছনে। তাই আমি
সেই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য একটু সময় চাইতেছিলাম। চাইতেছিলাম, একটু ডিটেইলে বলি।
এই লেখা আসলে সাইয়েদ জামিলকে লেখা সেই উত্তর। যা আমি আরও বহু আগেই বলতে চাইছিলাম একা
একা। নিজের জন্য, নিজের কাছে।
ফ্ল্যাশব্যাক
মেঘদল
কী জিনিস এই কথা বলার জন্য আমাকে একটু পেছনে তাকাতে হয়। সেইটা ২০০৬ সালের কথা। আমি
তখন পুরোদমে ছাত্র ইউনিয়ন ময়মনসিংহ জেলা কমিটিতে রাজনীতি করি। সেই সময় ছাত্র ইউনিয়নের
কেন্দ্রীয় সম্মেলন ফেব্রুয়ারিতে। সেই সম্মেলনে যোগ দিতে ময়মনসিংহ থেকে সদলবলে ঢাকায়
আসলাম। উদ্বোধনী দিনে রাজু ভাস্কর্য চত্বরে সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ছাত্র ইউনিয়নের
আমন্ত্রিত ব্যান্ড ‘চিৎকার’ আর ‘মেঘদল’। দুইটা ব্যান্ডের গান আমি সেবারই প্রথম শুনি। চিৎকারের
কয়েকটা চমৎকার গান শোনার পর (যার মাঝে একটা ছিলো হাট্টিমাটিম টিম লইয়া গবেষণা চালাইছে)
মেঘদল মঞ্চে দাঁড়ায়। সেই আমার মেঘদলকে চেনার শুরু। যা এখনও ধারাবাহিক। সেইবার ‘মেঘদল’ ঔম, ক্রুসেডসহ চার-কি পাঁচটি গান গায়। বায়োস্কোপের নেশা আমার যেমন ছাড়ে না, তেমনি চেপে
বসে মেঘদলের গানের নেশাও। সম্মেলন শেষে ময়মনসিংহে গিয়ে দেখি মেঘদলের অডিও অ্যালবাম
কেউ সেখানে নেয় নাই। নিবেই কিভাবে? তারা তো আর জনপ্রিয় ব্যান্ড না। কিন্তু মেঘদলের
গান এইভাবে না শুনে কেমনে দিন কাটাই? তাই ঢাকা থেকে মেঘদলের অডিও সিডি কিনে ময়মনসিংহে
নেয়া হলো। বন্ধুরা যেই কয়টা কপির চেষ্টা করছিলাম, ততগুলো পাওয়া গেলো না। পাওয়া গেলো
মাত্র এক কপি। আর তাই পালা করে কম্পিউটারে কপি করা। তারপর সবার মুখস্থ। ময়মনসিংহে পরিচিত
না হলেও ‘মেঘদল’ ঢাকায় মোটামোটি পপুলার। হুট করে একদিন দেখি অতনু (অতনু
তিয়াস) তাদের নিয়া ইত্তেফাকে একটা ফিচারও লিখলো। বাহ্ চমৎকার তো! আর কই যায়। সে বছরই
আমি রাজনীতি থেকে সরাসরি সরে আসি। কিন্তু মেঘদলের সাথে সম্পর্কটা ছাড়া হয় নি। বরং বেড়েছেই
বলা যায়। এইবার নিজেকে প্রশ্ন করি। আসলেই কি বেড়েছে? যদি বেড়েই থাকে তবে বলো দেখি,
মেঘদল কি?
এই
প্রশ্নের খোঁজা কি মূখ্য বিষয় কিনা জানিনা। তবে এ জানি মেঘদল আমাদের রোদের চিঠি, অথবা
বনসাই বনের মালি। কারণ, এই যে আমাদের চারপাশ ঘিরে আছে বেদনারহিত অনুভূতির দেয়াল এর
সীমানা কোনটা আমরা জানি না। জানি কখনও উসাইন বোল্টের মতো, কখনো ম্যারাথনের প্রতিযোগিদের
মতো দৌড়াইতেছি কেবল। এই দৌড়ের মধ্যে চুপচাপ যে হাওয়া বাতাস আসে, মনে সাহস আর অনুপ্রেরণাও
যোগায় সেইটা মেঘদলের গান।
রাজু
ভাস্কর্যের সামনে ঐদিন ঐ মঞ্চে যেই লাইনআপ ছিলো এখন বোধহয় সেই লাইনআপ হুবহু নাই। সেদিন
নগরের অতিথি আমি ভার্সিটির রাস্তায় নিজের জুতা পশ্চাদেশের নিচে দিয়া বসে পড়ছিলাম। গান
শুনছিলাম সম্ভবত চারটা কি পাঁচটা। তার মধ্যে ঔম, চতুর্দিকে, ক্রুসেড, ব্যবচ্ছেদ গানগুলো
ছিলো মনে করতে পারি।
তারপর
রিপিটেশনের কালে, একই গান বারবার বারবার শুনছি ঔম। কেন শুনছি এই প্রশ্ন করলে এখনো চুপ
হয়ে যাই। মনে হয়, কার কাছে দিবো এই উত্তর? সে কি গান শুনছিলো না সুর? নাকি কিছুটা হাওয়ায়
ভেসে আসা একটা চড়কির মতো কথাবার্তায় ঘুরপাক খাচ্ছে কেবল? আমার নিজের কাছে প্রশ্নগুলোরই
উত্তর মেলে না। অন্যকে কিভাবে উত্তর দেই!!!
ঔম
গানটা আমি নানান ধরনে মানুষকে শোনাইছি। একবার এক মুর্শীদি ভক্ত কবিরাজরে শুনাইছিলাম।
গান শুনে তিনি আমাকে জড়াইয়া ধরলেন। বললেন,
তুমি এমন সুন্দর গান কই পাইলা? তার চোখে মানুষের মুক্তির যে আনন্দ সেই আনন্দ দেখছিলাম।
সত্যি বলছি, সেই মুক্তির আনন্দ অনেক দিন কারো চোখে দেখি না। সব পরাজিত যোদ্ধা দেখি।
চোখের সামনে সব ক্লান্ত বিমর্ষ আর বিদঘুটে অন্ধকারময় খিলখিল হাসি। ঐদিন, ঐ মুর্শীদি
ভক্ত তার ভাবনার ধর্ম অধর্মের বিশাল লেকচার শুনাইছিলো। তর্ক হইছিলো তার সাথে, হইছিলো
আলোচনা। ভাবনার বিষয় বিস্তৃত হয়ে আর গানে ছিলো না। ছিলো ধর্ম আর মানুষে। দীর্ঘ সেই
সংলাপ শেষে আমরা যখন সমাপ্তির পর্দা টানি, তখন আমরা একমত হইছিলাম এই চিন্তায় যে, মানুষ
যে এত ধর্ম-ধর্ম করে-ধর্মেরও উচিত কিছু মানুষ-মানুষ করা। কিন্তু ঐ ধর্মই তো বায়বিয়।
আমরা কেমনে তার ছায়া মাড়াই? আমাদেও দুনিয়ার হাওয়া বাতাসে বাড়তে বাড়তে আমাদের চাইতে
বড় হয়ে যায় ধর্ম। কেমন বড়? তার কোনও আকার আয়তনের কথা আমরা বলতেই পারি না। তারে না যায়
ধরা, না যায় ছোঁয়া।
এবার
অন্য সুরে তাকাই, অন্য কথায়-সঙ্গীতে। আসলেই ধর্ম বলে কি কিছু আছে কি না, সেই প্রশ্নের
চাইতে তখন আমাদের চিন্তা খেলা করে জগৎ সংসার নিয়ে। মনে প্রশ্ন জাগে ‘মানুষের কজন ভগবান, ক’জনে ভাগ্য লেখে- ক’জনে জীবন সামলান?’ এই প্রশ্ন আর উত্তরের খেলা খেলতে গিয়ে আমরা হাওয়ার মতো অদৃশ্য কিছু উত্তরও
তাদের কাছ থেকে পাই। তারা বলে দিয়ে যায়, ‘আকাশে উড়ছে বোমারু ভগবান,
মানুষ ধ্বংসে যিনি গণতন্ত্র এনে দেন।’ কিন্তু এই উত্তরে আমাদের
স্বস্তি মেলে না। আমরা অস্বস্তি নিয়ে দৌড়ে উঠে বসি নিজ নিজ গন্তব্যের লোকাল বাসে। ফেরা
আর না ফেরার এক অস্পৃশ্য প্রতিবন্ধকতাও আমাদের সঙ্গে বাসে উঠে পড়ে। দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্তি
পায় আমাদের, ভুলে যায় বিষাদময় রাত্রীদিনের কথা। তন্দ্রাচ্ছন্নতা ঘিরে ধরে। আধো ঘুম
আধো জাগ্রত জগত থেকে অন্য এক জগতের দিকে হাঁটি আর তারাও কিনা বলে আমারই কথা, আমাদেরই
কথা-
আমি
হেঁটে যাই মেঘের কাছে
আমি
হেঁটে যাই
হেঁটে
যাই
প্রশ্বাসে
ছুঁয়েছি আকাশ
দুঃখ
ছুঁয়ে যায় বাতাসে বাতাসে
আমি
হেঁটে যাই
আমার
সকল পাপ ক্ষমা করে দিও তুমি মেঘ...
এক
অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে ধরে আমাদের। গলা ভিজে আসে পাপবোধে। বাড়ি ফেরার পথ ভুলে যাই। মনে
পরে সুদূরে প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা এক অবয়ব। কে সেই শান্তির দূত? যে অবয়বের চেয়ে বেশিকিছু
নয়, অথবা নেই তারে ছুঁয়ে যাওয়ার কোনও ছুতো। কেবল বুকের ভেতর থেকে অস্ফুট স্বরে বলে
উঠি... ‘ভালোবাসা হইয়ো তুমি পরজনমে’। কিন্তু তা হয় না। বরঙ ডানা মেলে অন্য এক ভূবনে, উড়ে যায় নিশিপাখির মতো, খুব
করে ভুলে যাওয়া এক পাখির ডানার মতো উড়ে যায়। হারিয়ে যায়, বিভ্রান্ত পথিকের মতো অচেনা
শহরে। সেই শহর কোথায়? কোন পথে ছুটলে সেই পথের সন্ধান মিলবে? আদৌ মিলবে কি না, তা জানা
নেই। থাকবে কি করে? নাগরিক কবিয়ালকে খুঁজতে খুঁজতে নিজেকেই হারিয়েছে ফেলেছি ‘চেনা অচেনা আলো আধারে, চলতি পথে কোনও বাসের ভীড়ে।’ অথচ প্রায় প্রতিরাতেই আমাদের শৈশব কান্না করে নগরীর নোনা ধরা দেয়ালে। দূরে
কোথাও আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়, আকাশে আলো ছায়ার খেলায় ভুলে যাই টানাপোড়েনের আলু-বেগুনের
দাম আর লোকাল বাসের ভাড়া। মনে মনে খেলা করে মৃত বিপ্লবের আত্মা-কান্নার বৃষ্টি নামে
শহরে আর-
আমার
শহর খুব সহজে একলা পাখির মতো ভিজতে থাকে
কেউ
জানে না কোন তীব্র শ্লোগান, মুখর
হতে এই শহরে
জানি,
শ্লোগান মুখর সময়ের গল্প আমাদের ভুরি-ভুরি। কিন্তু এই যে বন্ধ্যাকাল, ভেতর থেকে কোনও
আওয়াজ নেই। নেই মানুষের ডাকে মানুষের সাড়া দেয়ার মতো ব্যাক্তিত্ব। একেবারেই হারিয়ে
ফেলেছি মানবিকতা বোধের গোপন চিঠি। এমন সময়ে যারা সমাজে সবচেয়ে বেশী দায় বোধ করে, প্রকৃত
সংস্কৃতিকর্মী তারাই। যদিও সমাজে তার কর্মের প্রভাব আসে খুব ধীরে, কিন্তু স্থায়ি হয়
সেইটাই। এই দায়বোধটার অনেকটাই গ্রহণ করে মেঘদল। প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ভাষায় তাদের চেতনার
প্রকাশটাই অনেক সময় হয়ে উঠে সমাজের বেদনার ভাষা। এমন পরিস্থিতির কথাও কিন্তু তারা তাদের
গানেই বলে দিয়েছে আরও বহু আগে।
অস্থিরতায়,
নিমগ্নতায় পুড়ছে স্বদেশ পুড়ছে সবাই
তবু
রুখে দাঁড়াই আমরা!
ঘুরে
দাঁড়াই আমরা!! ফিরে দাঁড়াই!!!
এই
হলো শিল্পীর দায়বোধ। যা এড়িয়ে গেলে তাকে আর শিল্পী ভাবতে পারি না আমি। আসলে আমি ভাবতে
চাইও না। এই বিষয় নিয়ে অনেকের সাথে অনেক তর্ক আর আলোচনা হয়-হয়েছে। কিন্তু চিন্তার ক্ষেত্র
বদলায়নি। হয়তো মেঘদলও আমার মতো ভাবে না, কিন্তু আমি তাদের কাজে নিজের ভাবনার ছায়া পাই।
যা তাদেরকে নিজের মতো ভাবতে সহায়তা করে।
মেঘদল
আসলে গোপন এক আশ্রয়ের নাম। যখন নিজের সাথে নিজের লড়াই করার প্রয়োজন, তখন অন্তর্গত অনুপ্রেরণা
হিসেবে মেঘদল আসে। এই আশ্রয়ের অনুভূতি প্রকাশে বোদলেয়ারের আশ্রয় ছাড়া উপায় নেই; তাই
সেই ভাষাতেই বলি-
আমি
ভালোবাসি মেঘ... চলিষ্ণু মেঘ... ঐ উচুতে... ঐ উচুতে
আমি
ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল!
0 মন্তব্য(গুলি):