গত কয়েকদিন আগে কাজের ফাঁকে হঠাৎ
ফ্রান্সের একটি দৈনিক পত্রিকায় একটি সৌদি নারী চলচ্চিত্রকারের একটি সাক্ষাৎকার
চোখে পড়ল। ইন্টারভিউটি পড়ার পর জানা গেলো,
তিনিই সৌদি আরবের প্রথম নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা। এবং তার ছবি ভেনিস চলচ্চিত্র
উৎসবে একাধিক ও দুবাই চলচ্চিত্র উৎসবেও একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছে। উল্লেখ্য,
ইসলামী রক্ষণশীল আইনে জীবন পরিচালিত একটি দেশে নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা মানে
সত্যিই একটি বিরাট বিপ্লব। এই বিপ্লবে অনুপ্রেরণা দিতেই অনেকাংশে অর্থনৈতিক ভাবে
অনুন্নত বা উন্নত হলেও সাংস্কৃতিক ভাবে বিশ্বে কোনও প্রভাব ফেলতে না পারা জাতি বা
দেশগুলোর চলচ্চিত্র অনেক বড় বড় উৎসব কমিটি একটি বিশেষ দৃষ্টিতে দেখে থাকে। এটাকে
একদিক থেকে ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি বা অন্যদিক থেকে সংস্কৃতির উদার নৈতিকতার প্রমাণ
হিসেবেই দেখা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে পুরস্কৃত বা আলোচিত চলচ্চিত্রগুলো
সেইভাবেই আলোচনায় আসে, যেগুলো ইউরোপিয় দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে ‘প্রেজেন্টেড প্রডাক্ট’টির ভাবনা বা রূপ মিলে থাকে। আর এই
কথার প্রমাণ আমরা একটু চোখ মেলে তাকালেই দেখতে পাই। আমার চারপাশে এর বেশ কিছু
উদাহরণ রয়েছে। তার ভেতরে আমি সবার আগে রাখবো ২০১০ এর অস্কার পুরস্কারকে। সে বছর
ভারতীয় প্রেক্ষাপটের একটি গল্প নিয়ে হলিউড ভিত্তিক নির্মাতা ড্যানি বয়েল
বানিয়েছিলো স্লামডগ মিলিয়নিয়ার ছবিটি। ছবির নামটি যদি আপনি বাংলা করেন,
তাহলে দেখবেন সেখানে বস্তির একটি শিশুকে কুকুর হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। তারা আদতে
মানুষই নয়। আর এর মিলিয়নিয়ার হওয়ার গল্প যদি উৎকৃষ্ট রূপে ইউরোপিয়দের সামনে
প্রেজেন্টেশন করা যায়, তবে তা যে লুফে নিবেই তার প্রমাণ তো আপনার হাতের কাছেই।
তেমনি বাংলাদেশের দিকে তাকালেও আমরা ব্যতিক্রম দেখি না। বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত
যেসব ছবি বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছে সেগুলো যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যথেষ্ঠ
যুক্তিযুক্ত, তবুও সেগুলোতে বাংলাদেশকে ইউরোপিয়রা যেমন দেখতে চায় তেমনই দেখানো
হয়েছে। এই ক্ষেত্রে আমি সব সময়ই প্রত্যাশা করবো এমন কোনও গল্পের ছবি ইউরোপিয়দের
কাছ থেকে সেরার স্বীকৃতি ছিনিয়ে আনুক, যে ছবিটি কিনা আমরা যেভাবে বাংলাদেশকে দেখতে
পছন্দ করি সেভাবেই বা তেমন গল্প নিয়েই নির্মিত হয়েছে।
এতক্ষণ যে কাসুন্দি ঘাটলাম এর
একটা বড় কারণ হলো আমাদেরো এক ধরণের ইউরোপিয় নাক সিটকানো ভাবটা রয়েছে। আমরাও অনেক
সময় তাদের (ইউরোপিয়) চোখে দেখতে চাই বা দেখে থাকি। আর তাই আমরা প্রায়ই আমাদের
কর্মকে সবার আগে তুলনা করি তাদেরই সাথে। ফলশ্রুতিতে অনেক সময় অনেক বিভ্রান্তির
তৈরি হয়। এতে শেষ পর্যন্ত আমাদেরই ক্ষতি হয়। যা কখনোই কাম্য নয়। এই কথাগুলো বলার প্রধান কারণ বাংলাদেশের
চলচ্চিত্র ‘টেলিভিশন’ নিয়ে গল্প নকলের অভিযোগের প্রেক্ষাপটকে
নিয়ে। আমি মূলত মোস্তফা সরয়ার ফারুকী’র টেলিভিশন আর তুর্কী চলচ্চিত্র
নির্মাতা ইলমাজ ইর্দোগান এর ভিজনটেলে ’র তূলনামূলক
আলোচনার পথ তৈরি করতে চাই। তাই শুরুতেই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা নিয়ে অযথা
কথাগুলো বলে নিলাম।
![]() |
‘টেলিভিশন’ ছবির পোস্টার |
টেলিভিশন ছবি মুক্তির পরপরই যে অভিযোগটি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে
যায়, তা হলো এটি তুর্কী সিনেমার গল্প নকল করে বানানো। কিন্তু আদতে তা তুর্কী সিনেমার
গল্প নকল করে বানানো হয় নি। টেলিভিশন ছবির গল্প সম্পূর্ণ মৌলিক। বলতে গেলে
পরিচালকের বাবার ও তার নিজের জীবনের সাথে কিছুটা আত্ম জৈবনিকও । অপরদিকে তুর্কী
ছবির গল্প তেমন আত্ম জৈবনিক কি না তা জানা যায় নি। তবে দুইটা ছবিতেই কম বেশী
হাস্যরস, ট্রাজেডি, প্রেম, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ক্লাইমেক্স সবই রয়েছে। তবে
প্রত্যেকটাই নিজস্ব ঢংয়ে। এক্ষেত্রে ভিজনটেলে’র সাথে টেলিভিশন’এর ফর্মুলাগত মিল পাওয়া যায়। যদিও পৃথিবীর সর্বোচ্চ সংখ্যক ছবিই
প্রায় কাছাকাছি ফর্মূলা মেইনটেইন করে।
তুরস্ক অর্ধেক এশিয় আর অর্ধেক
ইউরোপিয়। তবে তার সংস্কৃতি ও জীবন ধারার সাথে ইউরোপের জীবনের মিল রয়েছে বেশী।
অর্থনৈতিকভাবে এশিয় সাধারণ দেশগুলোর চেয়ে একটু এগিয়ে থাকার পাশাপাশি ইউরোপের সাথে
সম্পর্ক ভালো থাকায় তারা কর্মে ও জাতেও বেশীরভাগ ইউরোপিয়ই। তার প্রমাণ তাদের
সিনেমাতেও পাওয়া যায়। এই ভিজনটেলে’র
নির্মাণশৈলি ও গল্প বলার ধরণ (স্টোরি টেলিং) কিন্তু বেশ আরামদায়ক। টেলিভিশন ছবিতে গল্প বলাটা পুরোপুরি আরামদায়ক না হলেও
পিড়াদায়ক নয়। তুর্কী ছবিটি আন্তর্জাতিকভাবে বেশ কিছু পুরস্কার পেলেও খুব
উল্লেখযোগ্য তেমন কোনও পুরস্কার তার ভাগ্যে জোটেনি। কিন্তু পুরো ছবিটা চমৎকার
উপভোগ্য বলেই কিনা, ছবিটি যথেষ্ঠ ব্যবসাসফল হয়েছিলো দেশে ও দেশের বাইরেও। এর
অনুপ্রেরণায় পরিচালক এই ছবির সিক্যুয়েল করেছিলেন।
![]() |
টার্কিস ‘ভিজনটেলে’ ছবির পোস্টার |
ভিজনটেলে দেখার সময় মনে হচ্ছিল ইউরোপেরই কোনো পরিচালক
ইচ্ছাপূর্বক একটু পুরনো আমেজে পুরনো একটি গল্প বলছেন। আর তাই কিছু কিছু অনুভূতির
ব্যবহার তিনি করেছেন দুর্দান্ত। ঠিক একই ধরণের হিসেব খাটানোর চেষ্টা আমরা দেখি টেলিভিশন
এ। এ ছবিতে কেবল প্রেমিকার অপমানের
পরই পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে উঠা যুবকটি পিতার আশ্রয়েই প্রতিপক্ষ হয়ে
গেলো। এটা সম্ভব মনে হলেও মেনে নিতে কষ্ট হয় এই কারণে যে, যে সন্তান পিতার অবাধ্য
হয়ে যায়, পিতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের দেশে সেই সন্তানকে বর্জন করে। এর ঠিক উল্টো রূপও রয়েছে। যার ফলে দেখা যায়
পিতা ও সন্তানের যে ট্রাডিশনাল বৈপরীত্য অনেক সময় প্রগতিশীল পিতা মেনে নেয়। কিন্তু
টেলিভিশন ‘র পিতা কিন্তু সেই প্রগতিশীল ব্যক্তি নয়। ফলে
এই বিরোধটা টিকে থাকার কথা থাকলেও উভয়েই স্ব স্ব অবস্থান থেকে এখানে সরে এসেছে।
যার দরুন, পিতা পুত্রের এই আঁচরণকে কিছুটা গরমিল মনে হয়েছে।
ভিজনটেলে’র মুল প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে আমরা পেয়েছি
প্রযুক্তির সুবিধা অনেক সময় হৃদয়ের বিপরীতে ধাবিত করতে পারে। একই সাথে যদি সেই
প্রযুক্তি যথাযথভাবে ব্যবহার করা না জানা থাকে তবে তা সম্পর্কে বিভ্রান্ত হওয়াটা
খুব স্বাভাবিক। বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ভাবনাটা দারুণ ভাবে
মিলে। তার প্রমাণ, স্বাধীনভাবে কথা বলার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হিসেবে প্রমাণিত
ইন্টারনেট ও ব্লগে প্রকাশিত কথা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ধর্মীয়
উন্মাদনা তৈরি করা।
বিপরীতে টেলিভিশন ছবির
মূল প্রতিপাদ্য আমরা পেয়েছি প্রযুক্তির কাছে পরাজিত গোড়ামি বা সংস্কার ভাবনা। যা
এক দিক দিয়ে প্রযুক্তির বিশাল গ্রহণযোগ্যতাকে উপস্থাপন করে, পাশাপাশি ধর্মের রক্ষণশীল
জায়গা থেকে সড়ে আসার যে আহ্বান তাও যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এইসব বিষয় তুচ্ছ
হয়ে যায় ছবির বিপনন পদ্ধতি বা চিন্তার কারণে। শুরুতে যে কথা বলার চেষ্টা করছিলাম, যে
ইউরোপিয়রা কেন তৃতীয় বিশ্বসহ শিল্প সাহিত্যের দিক থেকে তাদের চেয়ে একটু কম
পারঙ্গমদের কিভাবে মূল্যায়ন করে থাকে। সে প্রসঙ্গ চলে আসে কারণ টেলিভিশন ছবির
পরিচালকের বক্তব্য। ছবির পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,
সাম্প্রতিক কালের বাংলাদেশের দুই একজন পরিচালক ও তাদের ছবির কথা। নাম উল্লেখ না
করে তিনি বলেছিলেন ‘আমাদের দেশের কিছু পরিচালক পশ্চিমাদের
পছন্দের ছবি বানায়। কিন্তু তাদের সেই ছবি পশ্চিমের দেশগুলোতে আর বিক্রি হচ্ছে না।
যার কারণে আর পশ্চিমাদের পছন্দের কথা চিন্তা করে ছবি বানালে চলবে না।’ নিঃসন্দেহে এ আশার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত
রেকর্ড বলে টেলিভিশন ছবিতেও কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে সেই পশ্চিমাদের
দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই নির্মাণ করা হয়েছে বলে ধারণা করি। নয়তো টেলিভিশন শুধুমাত্র একটা
ধর্মীয় কারণে একটা গ্রামের মানুষদের নিষিদ্ধ প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে আবার সেই
টেলিভিশনের কাছেই পরাজয় স্বীকার করতে হয় না।
সব কিছুর পরেও মোস্তফা সরয়ার
ফারুকির টেলিভিশন আর ভিজনটেলে পৃথক দুটো ছবি। পৃথক অনুভূতির গল্প
বলে বিধায়ই কেবল ছবিগুলো পৃথক নয়, বরং আমি ভিটনটেলে কে এগিয়ে রাখবো তার নির্মাণশৈলি বা তার গল্প বলার ধরণের
কারণেই। সর্বোপরি দুটোই টেলিভিশন সংক্রান্ত সিনেমা।
(গদ্যটি লেখা হয়েছিলো ২০১৪ এর ফেব্রুয়ারিতে। ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে পড়াটাই নিরাপদ হবে।)
ভালো লাগলো। সরস আলোচনা উপভোগ্য ছিল।
উত্তরমুছুন