শনিবার, ২৫ আগস্ট, ২০১২


সে আসলো সকাল বেলা। তার ডাকাডাকি সকালের ঘুমটা নষ্ট করলো। দরজা খুলতে না খুলতেই একটা থাপ্পর বসাইয়া দিলো গালে। আমি হতভম্ব। ঘটনার কথা প্রশ্ন করতেই তো তার মেজাজ চড়কগাছ। বলে কিনা আর একটা কথা বললে দ্বিতীয়টা আর হাতে মারবে না। সর্বনাশ! এইবার তো মহা ফাপড়ে পরলাম। সাত সকালে এ কোন অলক্ষুণে ঘটনার শুরু? দেইখ্যা শুইন্যা দরজা থেইক্যা সইরা দাঁড়াইলাম। সে আইসা বাসার ভিতরে ঢুকলো। সাথে তার ইয়া বড় এক ব্যাগ। ব্যাগ না, আসলে ঐটারে আধুনিক ভাষায় লাগেজ বলে। আমিতো আশ্চর্য। এত বড় লাগেজ আমার বাসা পরিবর্তন করার সময়ও প্রয়োজন পরে না। আর সে এত বড় লাগেজ নিয়া আমার এইখানে কি করে? আমার এইসব প্রশ্ন ততক্ষণে অবান্তর। সে আইসা আমার ঘর দখল করে ফেললো রীতিমত। আমার নিজস্ব জগতের রাজা হয়ে যেনো সে প্রত্যাবর্তন করলো। ভাবখানা এমনই। আমার মেজাজের পারদ ততক্ষণে ৯০ ডিগ্রি অতিক্রম করতেছে।
ঘরে ঢুকেই প্রথমেই আমাকে বললো যাও অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমাইছো, এখন ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি দেখি, ফ্রিজে কি আছে গরম করি। তারপর বাকি কাজ করা যাবে। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। ঘড়ির দিকে তাকাইয়া দেখলাম বেলা বেশ হৈছে,  সকাল মাত্র ১০টা। মাত্র দশটা বাজে আর অনেক বেলা ঘুমাইছি? আমার তো এখনো পর্যাপ্ত ঘুমই হয় নাই। আমি যে ঘুমাইতে গেছি ভোর ৫টর সময়। আমার এই ঘুমের যে কি হবে ভাবতেই আমার গা গুলিয়ে আসতেছে। কিন্তু এখন গা গুলিয়ে আসলে বিপদ। এখন কাজ করতে হবে মাথা ঠান্ডা রেখে। যেহেতু সকাল সকাল একটা উটকো ঝামেলা এসে ঘারে চেপেছে, তার মোকাবেলা করতে হবে ঠান্ডা মাথায়ই। তাই ভাবলাম আগে ফ্রেশ হয়ে নেই। বাকিটা পরে দেখা যাবে। আমি বাথরুম থেকে ফিরে দেখি গতকালের বুয়ার রান্না করে রেখে যাওয়া ভাত, ডাল আর তরকারি গরম হয়ে গেছে। আমি বের হতেই সে বলে বসলো আসো, আসো আগে খেয়ে নেই। আমি বাসা থেকে খাইয়া আসি নাই। আমার প্রচুর ক্ষুধা লাগছে। তোমারো নিশ্চয়ই ক্ষুধা লাগছে না? তাই আগে খাওয়া, পরে সব কাজ। কি বলো? আমি কোনও কিছু বলার অবকাশ পাইলাম না। ক্ষুধা যে আমারও ততক্ষণে কিঞ্চিৎ লাগে নাই, এই কথা আমি অস্বীকার করি কেমনে? সেই ছোটবেলা থাকতে, মানে আমি যখন প্রথম বাড়ি ছাড়ি। বাড়ি ছাইরা অবশ্য একলা কোথাও যাই নাই। আমারে বাড়ি ছাড়া করছিলো আমার বাপে। ক্লাস সিক্সে থাকতেই আমারে হোস্টেল ওয়ালা স্কুলে ভর্তি করাই দিছিলো। তো সেইখানে আমার ঘুম ভাঙতো কাটায় কাটায় সকাল ৮টায়। মাঝে মাঝে একটু দেরিও হৈয়া যাইতো। ঐ হোস্টেলে আবার সকাল, দুপুর আর রাত তিনবেলাই খাওয়া দিতো। সকালের নাস্তা দিতো ৮টায়। আমি তাই ঘুম থেইক্যা উঠলেই ক্ষুধা লাগতো। ঘুম থেইক্যা উইঠ্যাই আমি তাই ফ্রেশ হইয়া থালা হাতে ডাইনিং এ ছুটতাম। ঐখানে থাকতে আমার এই বদ অভ্যাসটা হৈছে। আমি যখনই ঘুম থেইক্যা উঠি, তখনই ক্ষুধা লাগে। তাই যথারীতি আইজ সকাল সকাল ঘুম থেইক্যা উঠায় ক্ষুধাটাও সকাল সকালই চাগাড় দিয়া উঠলো। আইজ আমার রাজত্বে এই গেরিলা হানায় আমার দেড় রুমের রাজত্বে কিঞ্চিৎ ভাগ বসাইলো আরেকজন।
আমার দেড় রুমের ফ্ল্যাটের সর্বসাকুল্যে একটা রুম, এই আমার রাজত্ব। আর বাকী অর্ধেকটা ডাইনিং কাম ড্রয়িং। তাও আবার ঐ রুমে যাইতে হৈলে আমার বেড রুম অতিক্রম করেই যাইতে হয়। সবশেষে আছে ছোট্ট একখান কিচেন। আর বেড রুমের সাথে এটাচড একটা বাথ। ব্যাচেলরের রাজ্য হিসেবে এ অনেক বড় সাম্রাজ্য। যেহেতু আমার রুমে বাইরের লোকজনের যাতায়াত একটু কম, বলতে গেলে মাসে এক দুইবার দুই একজন বন্ধু আসলে তাদের নিয়া কেবল ড্রিংকস পার্টির আয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে এই ব্যাচেলর সাম্রাজ্য আমার এবং আমার স্বল্প সংখ্যক বন্ধুর জন্য অনেক বড় সাম্রাজ্য। রাতভর মদ খেয়ে ফ্লোরের বিছানায় হুমরি খেয়ে তিন চারজন একসাথে ঘুমাতে ভালোই লাগে। এই সাম্রাজ্যে গত মাস দুয়েক যাবৎ পার্টি হচ্ছে না। তার প্রধান কারণ, সব সময়ই পার্টির উদ্যোক্তা হঠাৎ বিনা নোটিশে বিয়ে করে ফেলায়। বেচারি হঠাৎ বিয়ে করে ফেলায় আমাদের উদ্যোগ্যে ভাটা পড়েছে। কিন্তু মন আনচান করতেছিলো। বিশেষ করে পরপর দুইটা পুর্ণিমা চলে যাওয়ার পরও আমাদের কোনও পার্টি-উর্টি নাই দেইখ্যা গেলো সপ্তাহে আমিই বাকি সবার লগে একটু আধটু উদ্যোক্তার ভূমিকা নিতে চাইছিলাম। কিন্তু আমারে দিয়া যা হওয়ার না তা তো হৈলো না। এই ফাকে আমার ঘারে এই উটকো ঝামেলা। শালার মেজাজটাই বিগড়ে দিলো।
হাফ ড্রয়িং কাম হাফ ডাইনিং রুমের মাঝখানে এ আমার একটা ম্যাট বিছানো আছে। বাড়িটা ব্যাচেলর হলে কি হবে আমি এখানে থাকছি প্রায় তিন বছর। এই সুযোগে একটু সত্যিকার অর্থে নিজের সাম্রাজ্য বানায়ে নিছি আমি। সেসবের অংশ হিসেবে এই হাফ ডাইনিং রুমও কিছুটা সজ্জিত হয়েছিলো। যার ম্যাটটাতে বসে বসে আমি দুইবেলা খাবার খাই। অধিকাংশ সময়ই সকালে আমার খাওয়া হয় না। দুপুরে একবারে খাই। আর বিকাল সন্ধ্যা বাড়ির বাইরে থাকাতে এই সময় আর বাসায় থাকা হয় না। রাতে বাসায় ফিরলে আর এক প্রস্থ খাওয়া হয়। ঐ ম্যাটে বসে আজ বহুদিন পর সকালের খাবার খাইলাম। খেতে বসে ভাবতেছিলাম এখন কি করা যায়? মনে হৈলো, খাওয়া শেষে ঘটনাটা পারি, জানি কি বৃত্তান্ত।
খাওয়া শেষে আমি কিছু বলতে শুরু করার আগে সে বলে উঠলো, তোমার তো এখন কাজ আছে। বাইরে যাবা। যাও। কিন্তু রাতে দেরি কইরা ফিরতে পারবা না কৈলাম। রাত দশটার পর ঘরের দরজা কিন্তু আমি বন্ধ কইরা দিবো। পরে কিন্তু হাজার ডাকলেও শুনবো না। বুইজ্যো। আমি তো থ। পুরা অধিকার খাটাইতেছে। কোত্থেকে কে না কে আইসা আমার ওপরে উইড়া আইসা জুইড়া বইছে। তাও আবার আমার ওপরে অধিকার খাটায়। এইবার আমার মেজাজ সপ্তমে চইড়া গেলো, তারপরও মেজাজ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাইখ্যা তারে বললাম দেখুন, আপনি কে না কে আমি আপনারে চিনি না। আপনি কি চান আমার কাছে? আমি আপনার কেউ না। আপনি এক্ষণ এই মুহূর্তে বাড়ি থেইক্যা বাইর হৈয়া যান। আমার কথায় মনে হয় কিছুটা কাজে ধরলো। সে ততক্ষণে আমারে এডভাইস দিয়া আমার এলোমেলো বিছানার দিকে হাত বাড়াইছিলো। আর বলতেছিলো, আমি মাত্র কয়দিনের জন্য বাড়ি গেলাম আর অমনি তোমার পুরানা স্বভাব আবার জাইগ্যা উঠলো? তোমারে বদলাইতে পারলাম না। কবে যে আমারে একটু শান্তি দিবা। শুইন্যা তো আমার মাথায় সপ্তম আসমান ভাইঙ্গা পড়লো, হায় আল্লাহ! এ কি কয়? সে আবার কবে ছিলো এইখানে?
একটু আগে বলে ফেলা আমার কথাগুলো বোধহয় ঐ সময় তার কানে ঢুকছিলো, কিন্তু মাথায় ঢুকে নাই। এখন মাথায় ঢুকার সাথে সাথে তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখাইতে শুরু করলো। যা কিছু সে এতক্ষণে গুছানো শুরু করছিলো, সব এলোমেলো কইরা দিলো। আর আমার সামনে আইসা চক্ষু দুইটা গরম কইরা বললো, মাত্র এক সপ্তাহের জন্য এত মেজাজ দেখাও? আমি মেজাজ দেখাইলে কিন্তু আর রক্ষা পাইবা না।
সর্বনাশ! এ কয় কি? আমার তো দেখি মাথা আরো আওলাইয়া গেলো। আমি চিন্তা করলাম, এর মাথা ঠান্ডা হলে তারপর তার মতো করে সব ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু আমি যে বাইরে যাবো এখন এই ফাকে যদি বাসার সবকিছু নিয়া ভাগে, তখন কি হৈবো? অবশ্য আমার একার সংসার থেইক্যা লইয়া ভাগার মত কিছু নাই। মানে টাকা-গয়না এইসব কিছু না। থাকার মধ্যে আমার ম্যাক পিসি আর টিভিটা। সাথে একখান ফ্রিজ। কেজি দরে বিক্রি করার মতো বেশকিছু বই। কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে না সে এই ধরনের কোনও মতলবে আসছে। তারপরও নিরাপত্তাই প্রথম বলে একটা কথা আছে। আর তাই নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি তার সাথে একটু ভাব জমাইতে চেষ্টা করলাম। বললাম, আমি তো বের হবো, কথা দিচ্ছি আমি সময় মতোই আসবো। কিন্তু একটা কথা ছিলো যে! দেখলাম একটু ঠান্ডা হৈছে। বললো কি কথা? আমি বললাম, বাইরে তো আর যাবে না। তাহলে আমি তালা দিয়ে যাই? বাইরে দিয়ে তালা দিয়ে যাওয়া মানে যে তাকে আটকে রাখা, এটা চিন্তা করেই কিনা তার মুখ কিছুটা চিন্তিত মনে হলো। হঠাৎই মুখের সেই চিন্তিত ভাবটা উধাও করে বললো, তুমি ভাবছো আবার আমি যদি চলে যাই এই কারণ। ঠিক আছে। তালা দিয়েই যাও। কারণ এবার তো আর আমি যাবার জন্য আসি নাই। তোমার ভয়ের কোনও কারণ নাই। তুমি যাও। আমি এর মধ্যে দুনিয়ার অষ্টম নবম আশ্চর্য কি কি হৈতে পারে তা চিন্তা করতে করতে রীতিমত ঘামতেছি। মাথার উপর ফুল স্পিডে ফ্যান চলতেছে, কিন্তু কোনও কাজ করতেছিলো না। কিন্তু তার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে নিজেরে আবিষ্কার করলাম অস্ট্রেলিয়ার কোনও ঠান্ডা রাজ্যে। মনে হইতেছে আমি এয়ারকুলারের বিজ্ঞাপনের মডেল। আহ্‌, শান্তি। আমি আর কিছু বললাম না। তার কথার প্রতি উত্তরে তারে মোহনীয় একটা হাসি দিয়া দ্রুত রেডি হইলাম। বের হওয়ার সময় বাইরে থেকে তালা দিতে আমার এইবার আর ভুল হৈলো না।
বাসা থেকে কিছুদূর হাটতে হাটতে বাস স্টেশন পর্যন্ত আসতে আসতে একটা চিন্তাই কেবল করতেছি। কি করা যায়? মাথায় কোনও কিছু আসতেছে না। বলতে গেলে এই সকালবেলা আমার কোনও কাজ নাই। গতকাল রাতে ক্লায়েন্টের কাজ শেষ করতেই দেরি হওয়ায় এখন নতুন কাজের ধান্দা ছাড়া অন্য কোনও টেনশন ছিলো না। সন্ধ্যায় পাভেল ভাইয়ের কাছে একবার যাওয়ার কথা। দিনের কাজ বলতে এইটুকুই। কিন্তু সন্ধ্যার আগে তো এই সমস্যার একটা বিহীত করতে হৈবো। মাথায় কোনও কিছু যখন কাজ না করে, তখন অন্যের সহায়তা নেওয়া নিরাপদ। তাই প্রথমে ধ্রুবর কথা মনে পড়লো। তারে দেখি পাওয়া যায় কিনা। ধ্রুবরে ফোনে পাওয়া গেলো। সে বাসায়ই আছে। তার বাসা শ্যামলীতে। মুহাম্মদপুর থেকে শ্যামলী খুব বেশী দূর না। সিএনজি নিতে হবে না। রিকশাই যথেষ্ঠ। টাকা কম থাকলে লেগুনা, তবে বাসের পথ নাই। আমার রিকশায় চড়তেই বেশী ভালো লাগে। আমি তাই একটা রিকশা ঠিক করলাম। শ্যামলী নাইম্যা রাস্তা পার হয়ে কাজী অফিসের গলিতে এক মিনিট হাটলেই ধ্রুবর বাসা। এগারটার মধ্যে আমি তার বাসায় গিয়া হাজির হৈলাম। গিয়া দেখি সে মাত্র ঘুম থেইক্যা উঠলো। আমি না আইলে হে এখনো ঘুমাইতো। যাই হোক, আমি যাইতেই আমারে জিজ্ঞাস করলো, চা খাবি? আমি হ্যা বলায় ধ্রুব তাদের বাড়ির কাজের মেয়েটারে ডাইক্যা দুই কাপ চা বানাইতে অর্ডার দিলো। চা আসতে আসতে ধ্রুব ফ্রেস হয়ে আসে। সে নিজেরে গুছায়া বসতে বসতে চা-ও আসে। চা হাতে নিয়া আমারে ধ্রুবর প্রশ্ন, এত্ত সকালে হঠাৎ কি মনে কইরা? ধ্রুব খুব ঠান্ডা মাথার ছেলে, আমরা বন্ধুরা বড় ধরনের সমস্যায় পরলে তার কাছে পরামর্শ চাই। সে খুব বিচার বিবেচনা কৈরা একটা সমাধান দেয়। যেই সমাধানটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়। তাই আমি তারে সব বিস্তারিত বলি। শোনার পর ধ্রুব খুব ঠান্ডা মাথায় ভাবতে ভাবতে চায়ে চুমুক দেয়। শব্দ করে চা খায় সে। ততক্ষণে চা অনেকটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আর আমার চা শেষও হয়ে গেছে। কিন্তু ধ্রুব চায়ে এমন করে চুমুক দেয় যেনো চা এখনো গরম। এইটা তার একটা বদ স্বভাব। চা শেষ করে ধ্রুব আমারে জিজ্ঞাস করে, তর এখন কি কাজ? আমি বললাম, এখন কোনও কাজ নাই। সন্ধ্যার সময় পাভেল ভাইয়ের কাছে যাওয়ার কথা। সে বললো, পাভেল ভাইরে ফোন করে বলে দে তুই আজকে যাচ্ছিস না, কালকে সন্ধ্যায় আসবি। আমি তাই করলাম। এখন আমরা দুইজনই চুপ। আমি ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছি। সে কি বলে তা শোনার জন্য। ধ্রুব খুব স্বাভাবিক হয়ে গেছে ততক্ষণে। বললো, তর যেহেতু আজকে আর কোনও কাজ নাই, আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত বাসায় সিনেমা দেইখ্যা কাটাই। একটা স্প্যানীশ ছবি আছে নতুন কাস্টিলোস দে কার্তুন নামে। ছবিটা মানুষের যৌথ দাম্পত্য জীবনের তিন বন্ধুর গল্প। আর্ন্তজাতিকভাবে খুব একটা সাড়া ফেলতে পারে নাই, কিন্তু তার ভাবনাটায় একটা নতুনত্ব আছে। ধ্রুব এই রকমই। কিচ্ছু করার নাই। দেড় ঘন্টার মাত্র ছবি। ছবি শেষে দুইজনে মিলে ছবি নিয়া আলোচনা। কিন্তু আমার আলোচনায় মন বসতেছে না। তিনটার দিকে আমি আর ধ্রুব তাদের বাসায় দুপুরের খাবার খাইলাম। সে বললো সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। সন্ধ্যায় একসাথে তোর বাসায় যাবো। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি একটা ঘুম দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুম ঠিক হৈয়াও হৈলো না। টেল্কি মাইরা পইরা রইলাম। বুঝতেছি সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়টা কিল করা ছাড়া উপায় নাই। আমি তাকায়া দেখি ধ্রুব নিশ্চিন্তে ঘুমাইতেছে। আমি আবারো ঘুমাইবার চেষ্টা করলাম। এইবার মনে হয় কিছুটা কাজেও দিলো। কিছুটা ঘুম আমার চোখে আসলোও। কিন্তু ফল হলো উল্টা। আমি এর মধ্যে স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। স্বপ্নে দেখলাম সকালে বাসায় আসা মেয়েটার খুব মন খারাপ। আমি বাসার পর আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করছে। চোখ মুছতে মুছতে তার জীবন যায় যায়। গলা ধরে আসায় কথাই বলতে পারতেছে না। আমি কিছুই বুইঝা উঠতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পর যখন তার কান্না থামলো তখন বলতে শুরু করলো, আমি চলে যাওয়ায় তোমার খুব কষ্ট হৈছে। আমি এমন ভুল আর কখনো করবো না। আমি আর কখনো তোমাকে না বলে বাড়ি চলে যাবো না। বলো তুমি আমাকে ক্ষমা করছো কিনা? আমি কোনও ভাষা খুঁজে পাই না। এই মহিলাকে আমি কি বলবো? তাকে কেমন করে বোঝাবো তার কাঙ্খিত ঠিকানার মানুষ আমি নই। কিন্তু তার এই অবস্থায় আমি কেমনে বুঝাই আমি আপনার স্বামী না, আমি এখনো ব্যাচেলর। এই অবস্থায় তাকে শান্তনা দিতে গিয়ে নিজের ভেতর অভিভাবকসুলভ আচরণ প্রকাশ পায়। এ অবস্থায় আমার ঘুম ভাইঙ্গা যায়। আমি উঠে ঘড়ির দিকে তাকায় দেখি সাড়ে ছয়টা বাজে। আমি ধ্রুবরে ডাইক্যা তুলি। শালা, আরামে ঘুমাস। আর আমার জান যায়, ওঠ। ধ্রুব ওঠে। উইঠ্যা হাতমুখ ধোয়, আমিও। বাসা থেইক্যা বাইর হৈয়া ধ্রুব চায়ের দোকানে যায়, আমি বান্দা তার সফরসঙ্গী। একখান চা আর একটা গোল্ডলিফ তার জন্য বরাদ্দ। আমার জন্য বেনসন আর চা। চা শেষ কৈরা বিল মিটায়া রিকশা নিলাম। রিকশা মোহাম্মদপুরের দিকে ছুটছে। খুব বেশীক্ষণ লাগলো না বাসায় আসতে। বাজে সাতটা ২০। আমার জন্য আল্টিমেটাম ছিলো দশটা। আমি হাল্কা কিছু বাজার করলাম। নুডুলস, দুই ডজন ডিম আর একটা মুরগী। সাথে একটা দেড় লিটারের সেভেন আপ। নুডুলস আমার খুব প্রিয়। নুডুল রান্না করতে ডিম লাগে। আর মাঝে মাঝে ড্রিংকস পার্টি হওয়ার কারণে সফট ড্রিংকসটা আমার ফ্রিজেই থাকে। তাই এইসব কেনা। বাসায় উঠছি। আমার পেছন পেছন ধ্রুব। আমি একটু অশ্বস্তিতে। ধ্রুবর কোনও বিকারই নাই। শালায় কি আজব মানুষরে। তালা দেওয়া দরজা খুলতেই সে এসে মনে হয় দরজার সামনে দাড়ালো। কিছু একটা বলতে চায় হয়তো সে। কিন্তু আমার পেছনে ধ্রুবকে দেখে একটু দমে যায়। কিন্তু আবার স্বাভাবিক। আমার হাত থেকে বাজারটা নিয়ে ফ্রিজে রাখে। আমি ধ্রুবরে নিয়া আপাতত বসার রুমটায় বসি। আমি খুব স্বাভাবিক গলায় তাকে জিজ্ঞেস করি, কিছু খাওয়া হৈছে? সে মাথা ঝাকিয়ে হ্যা জানালো। ধ্রুব এই ফাকে তার সাথে কথা বলা শুরু করে দিলো। নানান কথা। মনে হয় ধ্রুবর সাথেও তার আগে পরিচয় হৈছে। আমি কিছু বুঝতেছি না। আমার মেজাজ আবারও গরম হৈয়া যাইতেছে। এই ফাকে ধ্রুব আমারে ইশারায় বুঝাইলো, তার বাড়ির কথা জিগাইতে। আমি ফট করে বললাম, বাড়ির লোকজনের সাথে কথা হৈছে তোমার? সে নিজেকে অপরাধী মনে করে মাথা নারলো। বুঝলাম কথা হয় নাই। হৈবো কেমনে, তার কাছে তো ফোন নাই। ঝট করে আমি বললাম নাম্বারটা বলো তো, একটা ফোন দেই। সে গড় গড় করে একটা ফোন নাম্বার বললো। আমিও ডায়াল করলাম। ডায়াল করে বারান্দায় চলে যাই। ওইপাশ থেইক্যা ফোন উঠায় একজন মধ্য বয়স্ক মানুষ। আমি সালাম দিয়া জিগাই, আপনাদের মেয়ে কি হারিয়ে গেছে? ভদ্রলোক জানালেন হ্যা। আমি বিস্তারিত বললাম। তিনি আমার বাসার ঠিকানা জানতে চাইলেন। নিজেকে পরিচয় দিলেন মেয়েটার বড় ভাই হিসেবে। আমি বাসার ঠিকানা বললাম। উনি বললেন আজ রাতের মধ্যেই আসবেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বাড়ি? উনি জানালেন সাভার। আমি আশ্বস্ত হলাম যে, আজ রাতের মধ্যেই সমস্যার একটা সমাধান হবে আশা করি। এখন আমার দায়িত্ব হচ্ছে ঐ ভদ্রলোক না আশা পর্যন্ত তাকে কোনওভাবেই বুঝতে না দেয়া যে তাকে তাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আর ধ্রুবকেও ততক্ষণ ছাড়া যাবে না। ধ্রুবরে সব খুইল্যা কইলাম। ধ্রুবর কোনও গতন্তর নাই। এইদিকে আমার টেনশন বাড়তেছে। তিনি কখন আসবেন। অন্যদিকে সে রান্নার কাজে লেগে পরেছে। ধ্রুব ফাকে ফাকে তার সাথে আমার সাথে গেজাইতেছে। শালায় একটা বরফি, ঠান্ডা মাথার মানুষ। পারেও।
পৌনে দশটার দিকে দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। আমি কিছুটা স্তম্ভিত। আমার চেয়েও স্তম্ভিত সে। আমার মোহভঙ্গ হতে দেরি হয় নি। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। একজন চল্লিশোর্ধ বয়সী লোক দরজায় দাঁড়ানো। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো আপনি কি পাপন? আমি বললাম জ্বি। উনি উনার পরিচয় দিয়ে বললেন, আমার সাথেই আপনার কিছুক্ষণ আগে কথা হৈছে। আমি উনারে ভেতরে নিয়া আসলাম। ভদ্রলোককে দেখে তার চক্ষু ছানাভরা। সে রান্না করছিলো। ভদ্রলোক কোনও কথা বললেন না, রান্নাঘরে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি আবারও বোকা হৈয়া গেলাম। বুঝতেছিনা কি হয়। তারে হাত ধইরা নিয়া আসলেন তিনি। আমার দিকে তাকায়া তিনি বললেন, আপনারে কি বলে যে ধন্যবাদ দিবো বুঝতেছিনা। বলেই আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন তিনি। মেয়েটি নির্বাক। যেনো ভাষা হারাইয়া ফেলছে।

ঐ দিনেই মেয়েটিকে নিয়ে তার বড় ভাই চলে যায়। যাওয়ার আগে জানাইয়া যায়, মেয়েটার স্বামী দেখতে অনেকটা আমার মতোই। মাস খানেক আগে তার স্বামী রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। বছর খানেকও হয় নি তাদের বিয়ে হয়েছিলো। স্বামীর মৃত্যুর পর সে এই ঘটনা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। ক্ষণে ক্ষণেই পাগলের মতো আচরণ শুরু করতো। বলতো তার স্বামী মরে নাই। তার কাছে যেতে হবে তাকে। বেঁচে থাকতে তারা মোহাম্মদপুরেই থাকতো। আজ সকালে সবাই ঘুম থেকে উঠার পর হঠাৎ টের পায় সে নেই। এর পর থেকে সম্ভাব্য সকল স্থানে তাকে সারাদিন খোঁজা হৈছে। কিন্তু সে যে ঠিকানা ভুল করে মোহাম্মদপুরে আমার বাসায় এসে উঠবে এটা কে জানতো!

সে অথবা তার ছায়ার গল্প

at শনিবার, আগস্ট ২৫, ২০১২  |  2 comments


সে আসলো সকাল বেলা। তার ডাকাডাকি সকালের ঘুমটা নষ্ট করলো। দরজা খুলতে না খুলতেই একটা থাপ্পর বসাইয়া দিলো গালে। আমি হতভম্ব। ঘটনার কথা প্রশ্ন করতেই তো তার মেজাজ চড়কগাছ। বলে কিনা আর একটা কথা বললে দ্বিতীয়টা আর হাতে মারবে না। সর্বনাশ! এইবার তো মহা ফাপড়ে পরলাম। সাত সকালে এ কোন অলক্ষুণে ঘটনার শুরু? দেইখ্যা শুইন্যা দরজা থেইক্যা সইরা দাঁড়াইলাম। সে আইসা বাসার ভিতরে ঢুকলো। সাথে তার ইয়া বড় এক ব্যাগ। ব্যাগ না, আসলে ঐটারে আধুনিক ভাষায় লাগেজ বলে। আমিতো আশ্চর্য। এত বড় লাগেজ আমার বাসা পরিবর্তন করার সময়ও প্রয়োজন পরে না। আর সে এত বড় লাগেজ নিয়া আমার এইখানে কি করে? আমার এইসব প্রশ্ন ততক্ষণে অবান্তর। সে আইসা আমার ঘর দখল করে ফেললো রীতিমত। আমার নিজস্ব জগতের রাজা হয়ে যেনো সে প্রত্যাবর্তন করলো। ভাবখানা এমনই। আমার মেজাজের পারদ ততক্ষণে ৯০ ডিগ্রি অতিক্রম করতেছে।
ঘরে ঢুকেই প্রথমেই আমাকে বললো যাও অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমাইছো, এখন ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি দেখি, ফ্রিজে কি আছে গরম করি। তারপর বাকি কাজ করা যাবে। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। ঘড়ির দিকে তাকাইয়া দেখলাম বেলা বেশ হৈছে,  সকাল মাত্র ১০টা। মাত্র দশটা বাজে আর অনেক বেলা ঘুমাইছি? আমার তো এখনো পর্যাপ্ত ঘুমই হয় নাই। আমি যে ঘুমাইতে গেছি ভোর ৫টর সময়। আমার এই ঘুমের যে কি হবে ভাবতেই আমার গা গুলিয়ে আসতেছে। কিন্তু এখন গা গুলিয়ে আসলে বিপদ। এখন কাজ করতে হবে মাথা ঠান্ডা রেখে। যেহেতু সকাল সকাল একটা উটকো ঝামেলা এসে ঘারে চেপেছে, তার মোকাবেলা করতে হবে ঠান্ডা মাথায়ই। তাই ভাবলাম আগে ফ্রেশ হয়ে নেই। বাকিটা পরে দেখা যাবে। আমি বাথরুম থেকে ফিরে দেখি গতকালের বুয়ার রান্না করে রেখে যাওয়া ভাত, ডাল আর তরকারি গরম হয়ে গেছে। আমি বের হতেই সে বলে বসলো আসো, আসো আগে খেয়ে নেই। আমি বাসা থেকে খাইয়া আসি নাই। আমার প্রচুর ক্ষুধা লাগছে। তোমারো নিশ্চয়ই ক্ষুধা লাগছে না? তাই আগে খাওয়া, পরে সব কাজ। কি বলো? আমি কোনও কিছু বলার অবকাশ পাইলাম না। ক্ষুধা যে আমারও ততক্ষণে কিঞ্চিৎ লাগে নাই, এই কথা আমি অস্বীকার করি কেমনে? সেই ছোটবেলা থাকতে, মানে আমি যখন প্রথম বাড়ি ছাড়ি। বাড়ি ছাইরা অবশ্য একলা কোথাও যাই নাই। আমারে বাড়ি ছাড়া করছিলো আমার বাপে। ক্লাস সিক্সে থাকতেই আমারে হোস্টেল ওয়ালা স্কুলে ভর্তি করাই দিছিলো। তো সেইখানে আমার ঘুম ভাঙতো কাটায় কাটায় সকাল ৮টায়। মাঝে মাঝে একটু দেরিও হৈয়া যাইতো। ঐ হোস্টেলে আবার সকাল, দুপুর আর রাত তিনবেলাই খাওয়া দিতো। সকালের নাস্তা দিতো ৮টায়। আমি তাই ঘুম থেইক্যা উঠলেই ক্ষুধা লাগতো। ঘুম থেইক্যা উইঠ্যাই আমি তাই ফ্রেশ হইয়া থালা হাতে ডাইনিং এ ছুটতাম। ঐখানে থাকতে আমার এই বদ অভ্যাসটা হৈছে। আমি যখনই ঘুম থেইক্যা উঠি, তখনই ক্ষুধা লাগে। তাই যথারীতি আইজ সকাল সকাল ঘুম থেইক্যা উঠায় ক্ষুধাটাও সকাল সকালই চাগাড় দিয়া উঠলো। আইজ আমার রাজত্বে এই গেরিলা হানায় আমার দেড় রুমের রাজত্বে কিঞ্চিৎ ভাগ বসাইলো আরেকজন।
আমার দেড় রুমের ফ্ল্যাটের সর্বসাকুল্যে একটা রুম, এই আমার রাজত্ব। আর বাকী অর্ধেকটা ডাইনিং কাম ড্রয়িং। তাও আবার ঐ রুমে যাইতে হৈলে আমার বেড রুম অতিক্রম করেই যাইতে হয়। সবশেষে আছে ছোট্ট একখান কিচেন। আর বেড রুমের সাথে এটাচড একটা বাথ। ব্যাচেলরের রাজ্য হিসেবে এ অনেক বড় সাম্রাজ্য। যেহেতু আমার রুমে বাইরের লোকজনের যাতায়াত একটু কম, বলতে গেলে মাসে এক দুইবার দুই একজন বন্ধু আসলে তাদের নিয়া কেবল ড্রিংকস পার্টির আয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে এই ব্যাচেলর সাম্রাজ্য আমার এবং আমার স্বল্প সংখ্যক বন্ধুর জন্য অনেক বড় সাম্রাজ্য। রাতভর মদ খেয়ে ফ্লোরের বিছানায় হুমরি খেয়ে তিন চারজন একসাথে ঘুমাতে ভালোই লাগে। এই সাম্রাজ্যে গত মাস দুয়েক যাবৎ পার্টি হচ্ছে না। তার প্রধান কারণ, সব সময়ই পার্টির উদ্যোক্তা হঠাৎ বিনা নোটিশে বিয়ে করে ফেলায়। বেচারি হঠাৎ বিয়ে করে ফেলায় আমাদের উদ্যোগ্যে ভাটা পড়েছে। কিন্তু মন আনচান করতেছিলো। বিশেষ করে পরপর দুইটা পুর্ণিমা চলে যাওয়ার পরও আমাদের কোনও পার্টি-উর্টি নাই দেইখ্যা গেলো সপ্তাহে আমিই বাকি সবার লগে একটু আধটু উদ্যোক্তার ভূমিকা নিতে চাইছিলাম। কিন্তু আমারে দিয়া যা হওয়ার না তা তো হৈলো না। এই ফাকে আমার ঘারে এই উটকো ঝামেলা। শালার মেজাজটাই বিগড়ে দিলো।
হাফ ড্রয়িং কাম হাফ ডাইনিং রুমের মাঝখানে এ আমার একটা ম্যাট বিছানো আছে। বাড়িটা ব্যাচেলর হলে কি হবে আমি এখানে থাকছি প্রায় তিন বছর। এই সুযোগে একটু সত্যিকার অর্থে নিজের সাম্রাজ্য বানায়ে নিছি আমি। সেসবের অংশ হিসেবে এই হাফ ডাইনিং রুমও কিছুটা সজ্জিত হয়েছিলো। যার ম্যাটটাতে বসে বসে আমি দুইবেলা খাবার খাই। অধিকাংশ সময়ই সকালে আমার খাওয়া হয় না। দুপুরে একবারে খাই। আর বিকাল সন্ধ্যা বাড়ির বাইরে থাকাতে এই সময় আর বাসায় থাকা হয় না। রাতে বাসায় ফিরলে আর এক প্রস্থ খাওয়া হয়। ঐ ম্যাটে বসে আজ বহুদিন পর সকালের খাবার খাইলাম। খেতে বসে ভাবতেছিলাম এখন কি করা যায়? মনে হৈলো, খাওয়া শেষে ঘটনাটা পারি, জানি কি বৃত্তান্ত।
খাওয়া শেষে আমি কিছু বলতে শুরু করার আগে সে বলে উঠলো, তোমার তো এখন কাজ আছে। বাইরে যাবা। যাও। কিন্তু রাতে দেরি কইরা ফিরতে পারবা না কৈলাম। রাত দশটার পর ঘরের দরজা কিন্তু আমি বন্ধ কইরা দিবো। পরে কিন্তু হাজার ডাকলেও শুনবো না। বুইজ্যো। আমি তো থ। পুরা অধিকার খাটাইতেছে। কোত্থেকে কে না কে আইসা আমার ওপরে উইড়া আইসা জুইড়া বইছে। তাও আবার আমার ওপরে অধিকার খাটায়। এইবার আমার মেজাজ সপ্তমে চইড়া গেলো, তারপরও মেজাজ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাইখ্যা তারে বললাম দেখুন, আপনি কে না কে আমি আপনারে চিনি না। আপনি কি চান আমার কাছে? আমি আপনার কেউ না। আপনি এক্ষণ এই মুহূর্তে বাড়ি থেইক্যা বাইর হৈয়া যান। আমার কথায় মনে হয় কিছুটা কাজে ধরলো। সে ততক্ষণে আমারে এডভাইস দিয়া আমার এলোমেলো বিছানার দিকে হাত বাড়াইছিলো। আর বলতেছিলো, আমি মাত্র কয়দিনের জন্য বাড়ি গেলাম আর অমনি তোমার পুরানা স্বভাব আবার জাইগ্যা উঠলো? তোমারে বদলাইতে পারলাম না। কবে যে আমারে একটু শান্তি দিবা। শুইন্যা তো আমার মাথায় সপ্তম আসমান ভাইঙ্গা পড়লো, হায় আল্লাহ! এ কি কয়? সে আবার কবে ছিলো এইখানে?
একটু আগে বলে ফেলা আমার কথাগুলো বোধহয় ঐ সময় তার কানে ঢুকছিলো, কিন্তু মাথায় ঢুকে নাই। এখন মাথায় ঢুকার সাথে সাথে তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখাইতে শুরু করলো। যা কিছু সে এতক্ষণে গুছানো শুরু করছিলো, সব এলোমেলো কইরা দিলো। আর আমার সামনে আইসা চক্ষু দুইটা গরম কইরা বললো, মাত্র এক সপ্তাহের জন্য এত মেজাজ দেখাও? আমি মেজাজ দেখাইলে কিন্তু আর রক্ষা পাইবা না।
সর্বনাশ! এ কয় কি? আমার তো দেখি মাথা আরো আওলাইয়া গেলো। আমি চিন্তা করলাম, এর মাথা ঠান্ডা হলে তারপর তার মতো করে সব ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু আমি যে বাইরে যাবো এখন এই ফাকে যদি বাসার সবকিছু নিয়া ভাগে, তখন কি হৈবো? অবশ্য আমার একার সংসার থেইক্যা লইয়া ভাগার মত কিছু নাই। মানে টাকা-গয়না এইসব কিছু না। থাকার মধ্যে আমার ম্যাক পিসি আর টিভিটা। সাথে একখান ফ্রিজ। কেজি দরে বিক্রি করার মতো বেশকিছু বই। কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে না সে এই ধরনের কোনও মতলবে আসছে। তারপরও নিরাপত্তাই প্রথম বলে একটা কথা আছে। আর তাই নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি তার সাথে একটু ভাব জমাইতে চেষ্টা করলাম। বললাম, আমি তো বের হবো, কথা দিচ্ছি আমি সময় মতোই আসবো। কিন্তু একটা কথা ছিলো যে! দেখলাম একটু ঠান্ডা হৈছে। বললো কি কথা? আমি বললাম, বাইরে তো আর যাবে না। তাহলে আমি তালা দিয়ে যাই? বাইরে দিয়ে তালা দিয়ে যাওয়া মানে যে তাকে আটকে রাখা, এটা চিন্তা করেই কিনা তার মুখ কিছুটা চিন্তিত মনে হলো। হঠাৎই মুখের সেই চিন্তিত ভাবটা উধাও করে বললো, তুমি ভাবছো আবার আমি যদি চলে যাই এই কারণ। ঠিক আছে। তালা দিয়েই যাও। কারণ এবার তো আর আমি যাবার জন্য আসি নাই। তোমার ভয়ের কোনও কারণ নাই। তুমি যাও। আমি এর মধ্যে দুনিয়ার অষ্টম নবম আশ্চর্য কি কি হৈতে পারে তা চিন্তা করতে করতে রীতিমত ঘামতেছি। মাথার উপর ফুল স্পিডে ফ্যান চলতেছে, কিন্তু কোনও কাজ করতেছিলো না। কিন্তু তার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে নিজেরে আবিষ্কার করলাম অস্ট্রেলিয়ার কোনও ঠান্ডা রাজ্যে। মনে হইতেছে আমি এয়ারকুলারের বিজ্ঞাপনের মডেল। আহ্‌, শান্তি। আমি আর কিছু বললাম না। তার কথার প্রতি উত্তরে তারে মোহনীয় একটা হাসি দিয়া দ্রুত রেডি হইলাম। বের হওয়ার সময় বাইরে থেকে তালা দিতে আমার এইবার আর ভুল হৈলো না।
বাসা থেকে কিছুদূর হাটতে হাটতে বাস স্টেশন পর্যন্ত আসতে আসতে একটা চিন্তাই কেবল করতেছি। কি করা যায়? মাথায় কোনও কিছু আসতেছে না। বলতে গেলে এই সকালবেলা আমার কোনও কাজ নাই। গতকাল রাতে ক্লায়েন্টের কাজ শেষ করতেই দেরি হওয়ায় এখন নতুন কাজের ধান্দা ছাড়া অন্য কোনও টেনশন ছিলো না। সন্ধ্যায় পাভেল ভাইয়ের কাছে একবার যাওয়ার কথা। দিনের কাজ বলতে এইটুকুই। কিন্তু সন্ধ্যার আগে তো এই সমস্যার একটা বিহীত করতে হৈবো। মাথায় কোনও কিছু যখন কাজ না করে, তখন অন্যের সহায়তা নেওয়া নিরাপদ। তাই প্রথমে ধ্রুবর কথা মনে পড়লো। তারে দেখি পাওয়া যায় কিনা। ধ্রুবরে ফোনে পাওয়া গেলো। সে বাসায়ই আছে। তার বাসা শ্যামলীতে। মুহাম্মদপুর থেকে শ্যামলী খুব বেশী দূর না। সিএনজি নিতে হবে না। রিকশাই যথেষ্ঠ। টাকা কম থাকলে লেগুনা, তবে বাসের পথ নাই। আমার রিকশায় চড়তেই বেশী ভালো লাগে। আমি তাই একটা রিকশা ঠিক করলাম। শ্যামলী নাইম্যা রাস্তা পার হয়ে কাজী অফিসের গলিতে এক মিনিট হাটলেই ধ্রুবর বাসা। এগারটার মধ্যে আমি তার বাসায় গিয়া হাজির হৈলাম। গিয়া দেখি সে মাত্র ঘুম থেইক্যা উঠলো। আমি না আইলে হে এখনো ঘুমাইতো। যাই হোক, আমি যাইতেই আমারে জিজ্ঞাস করলো, চা খাবি? আমি হ্যা বলায় ধ্রুব তাদের বাড়ির কাজের মেয়েটারে ডাইক্যা দুই কাপ চা বানাইতে অর্ডার দিলো। চা আসতে আসতে ধ্রুব ফ্রেস হয়ে আসে। সে নিজেরে গুছায়া বসতে বসতে চা-ও আসে। চা হাতে নিয়া আমারে ধ্রুবর প্রশ্ন, এত্ত সকালে হঠাৎ কি মনে কইরা? ধ্রুব খুব ঠান্ডা মাথার ছেলে, আমরা বন্ধুরা বড় ধরনের সমস্যায় পরলে তার কাছে পরামর্শ চাই। সে খুব বিচার বিবেচনা কৈরা একটা সমাধান দেয়। যেই সমাধানটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়। তাই আমি তারে সব বিস্তারিত বলি। শোনার পর ধ্রুব খুব ঠান্ডা মাথায় ভাবতে ভাবতে চায়ে চুমুক দেয়। শব্দ করে চা খায় সে। ততক্ষণে চা অনেকটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। আর আমার চা শেষও হয়ে গেছে। কিন্তু ধ্রুব চায়ে এমন করে চুমুক দেয় যেনো চা এখনো গরম। এইটা তার একটা বদ স্বভাব। চা শেষ করে ধ্রুব আমারে জিজ্ঞাস করে, তর এখন কি কাজ? আমি বললাম, এখন কোনও কাজ নাই। সন্ধ্যার সময় পাভেল ভাইয়ের কাছে যাওয়ার কথা। সে বললো, পাভেল ভাইরে ফোন করে বলে দে তুই আজকে যাচ্ছিস না, কালকে সন্ধ্যায় আসবি। আমি তাই করলাম। এখন আমরা দুইজনই চুপ। আমি ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছি। সে কি বলে তা শোনার জন্য। ধ্রুব খুব স্বাভাবিক হয়ে গেছে ততক্ষণে। বললো, তর যেহেতু আজকে আর কোনও কাজ নাই, আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত বাসায় সিনেমা দেইখ্যা কাটাই। একটা স্প্যানীশ ছবি আছে নতুন কাস্টিলোস দে কার্তুন নামে। ছবিটা মানুষের যৌথ দাম্পত্য জীবনের তিন বন্ধুর গল্প। আর্ন্তজাতিকভাবে খুব একটা সাড়া ফেলতে পারে নাই, কিন্তু তার ভাবনাটায় একটা নতুনত্ব আছে। ধ্রুব এই রকমই। কিচ্ছু করার নাই। দেড় ঘন্টার মাত্র ছবি। ছবি শেষে দুইজনে মিলে ছবি নিয়া আলোচনা। কিন্তু আমার আলোচনায় মন বসতেছে না। তিনটার দিকে আমি আর ধ্রুব তাদের বাসায় দুপুরের খাবার খাইলাম। সে বললো সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। সন্ধ্যায় একসাথে তোর বাসায় যাবো। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি একটা ঘুম দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুম ঠিক হৈয়াও হৈলো না। টেল্কি মাইরা পইরা রইলাম। বুঝতেছি সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়টা কিল করা ছাড়া উপায় নাই। আমি তাকায়া দেখি ধ্রুব নিশ্চিন্তে ঘুমাইতেছে। আমি আবারো ঘুমাইবার চেষ্টা করলাম। এইবার মনে হয় কিছুটা কাজেও দিলো। কিছুটা ঘুম আমার চোখে আসলোও। কিন্তু ফল হলো উল্টা। আমি এর মধ্যে স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। স্বপ্নে দেখলাম সকালে বাসায় আসা মেয়েটার খুব মন খারাপ। আমি বাসার পর আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করছে। চোখ মুছতে মুছতে তার জীবন যায় যায়। গলা ধরে আসায় কথাই বলতে পারতেছে না। আমি কিছুই বুইঝা উঠতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পর যখন তার কান্না থামলো তখন বলতে শুরু করলো, আমি চলে যাওয়ায় তোমার খুব কষ্ট হৈছে। আমি এমন ভুল আর কখনো করবো না। আমি আর কখনো তোমাকে না বলে বাড়ি চলে যাবো না। বলো তুমি আমাকে ক্ষমা করছো কিনা? আমি কোনও ভাষা খুঁজে পাই না। এই মহিলাকে আমি কি বলবো? তাকে কেমন করে বোঝাবো তার কাঙ্খিত ঠিকানার মানুষ আমি নই। কিন্তু তার এই অবস্থায় আমি কেমনে বুঝাই আমি আপনার স্বামী না, আমি এখনো ব্যাচেলর। এই অবস্থায় তাকে শান্তনা দিতে গিয়ে নিজের ভেতর অভিভাবকসুলভ আচরণ প্রকাশ পায়। এ অবস্থায় আমার ঘুম ভাইঙ্গা যায়। আমি উঠে ঘড়ির দিকে তাকায় দেখি সাড়ে ছয়টা বাজে। আমি ধ্রুবরে ডাইক্যা তুলি। শালা, আরামে ঘুমাস। আর আমার জান যায়, ওঠ। ধ্রুব ওঠে। উইঠ্যা হাতমুখ ধোয়, আমিও। বাসা থেইক্যা বাইর হৈয়া ধ্রুব চায়ের দোকানে যায়, আমি বান্দা তার সফরসঙ্গী। একখান চা আর একটা গোল্ডলিফ তার জন্য বরাদ্দ। আমার জন্য বেনসন আর চা। চা শেষ কৈরা বিল মিটায়া রিকশা নিলাম। রিকশা মোহাম্মদপুরের দিকে ছুটছে। খুব বেশীক্ষণ লাগলো না বাসায় আসতে। বাজে সাতটা ২০। আমার জন্য আল্টিমেটাম ছিলো দশটা। আমি হাল্কা কিছু বাজার করলাম। নুডুলস, দুই ডজন ডিম আর একটা মুরগী। সাথে একটা দেড় লিটারের সেভেন আপ। নুডুলস আমার খুব প্রিয়। নুডুল রান্না করতে ডিম লাগে। আর মাঝে মাঝে ড্রিংকস পার্টি হওয়ার কারণে সফট ড্রিংকসটা আমার ফ্রিজেই থাকে। তাই এইসব কেনা। বাসায় উঠছি। আমার পেছন পেছন ধ্রুব। আমি একটু অশ্বস্তিতে। ধ্রুবর কোনও বিকারই নাই। শালায় কি আজব মানুষরে। তালা দেওয়া দরজা খুলতেই সে এসে মনে হয় দরজার সামনে দাড়ালো। কিছু একটা বলতে চায় হয়তো সে। কিন্তু আমার পেছনে ধ্রুবকে দেখে একটু দমে যায়। কিন্তু আবার স্বাভাবিক। আমার হাত থেকে বাজারটা নিয়ে ফ্রিজে রাখে। আমি ধ্রুবরে নিয়া আপাতত বসার রুমটায় বসি। আমি খুব স্বাভাবিক গলায় তাকে জিজ্ঞেস করি, কিছু খাওয়া হৈছে? সে মাথা ঝাকিয়ে হ্যা জানালো। ধ্রুব এই ফাকে তার সাথে কথা বলা শুরু করে দিলো। নানান কথা। মনে হয় ধ্রুবর সাথেও তার আগে পরিচয় হৈছে। আমি কিছু বুঝতেছি না। আমার মেজাজ আবারও গরম হৈয়া যাইতেছে। এই ফাকে ধ্রুব আমারে ইশারায় বুঝাইলো, তার বাড়ির কথা জিগাইতে। আমি ফট করে বললাম, বাড়ির লোকজনের সাথে কথা হৈছে তোমার? সে নিজেকে অপরাধী মনে করে মাথা নারলো। বুঝলাম কথা হয় নাই। হৈবো কেমনে, তার কাছে তো ফোন নাই। ঝট করে আমি বললাম নাম্বারটা বলো তো, একটা ফোন দেই। সে গড় গড় করে একটা ফোন নাম্বার বললো। আমিও ডায়াল করলাম। ডায়াল করে বারান্দায় চলে যাই। ওইপাশ থেইক্যা ফোন উঠায় একজন মধ্য বয়স্ক মানুষ। আমি সালাম দিয়া জিগাই, আপনাদের মেয়ে কি হারিয়ে গেছে? ভদ্রলোক জানালেন হ্যা। আমি বিস্তারিত বললাম। তিনি আমার বাসার ঠিকানা জানতে চাইলেন। নিজেকে পরিচয় দিলেন মেয়েটার বড় ভাই হিসেবে। আমি বাসার ঠিকানা বললাম। উনি বললেন আজ রাতের মধ্যেই আসবেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বাড়ি? উনি জানালেন সাভার। আমি আশ্বস্ত হলাম যে, আজ রাতের মধ্যেই সমস্যার একটা সমাধান হবে আশা করি। এখন আমার দায়িত্ব হচ্ছে ঐ ভদ্রলোক না আশা পর্যন্ত তাকে কোনওভাবেই বুঝতে না দেয়া যে তাকে তাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আর ধ্রুবকেও ততক্ষণ ছাড়া যাবে না। ধ্রুবরে সব খুইল্যা কইলাম। ধ্রুবর কোনও গতন্তর নাই। এইদিকে আমার টেনশন বাড়তেছে। তিনি কখন আসবেন। অন্যদিকে সে রান্নার কাজে লেগে পরেছে। ধ্রুব ফাকে ফাকে তার সাথে আমার সাথে গেজাইতেছে। শালায় একটা বরফি, ঠান্ডা মাথার মানুষ। পারেও।
পৌনে দশটার দিকে দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। আমি কিছুটা স্তম্ভিত। আমার চেয়েও স্তম্ভিত সে। আমার মোহভঙ্গ হতে দেরি হয় নি। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। একজন চল্লিশোর্ধ বয়সী লোক দরজায় দাঁড়ানো। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো আপনি কি পাপন? আমি বললাম জ্বি। উনি উনার পরিচয় দিয়ে বললেন, আমার সাথেই আপনার কিছুক্ষণ আগে কথা হৈছে। আমি উনারে ভেতরে নিয়া আসলাম। ভদ্রলোককে দেখে তার চক্ষু ছানাভরা। সে রান্না করছিলো। ভদ্রলোক কোনও কথা বললেন না, রান্নাঘরে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি আবারও বোকা হৈয়া গেলাম। বুঝতেছিনা কি হয়। তারে হাত ধইরা নিয়া আসলেন তিনি। আমার দিকে তাকায়া তিনি বললেন, আপনারে কি বলে যে ধন্যবাদ দিবো বুঝতেছিনা। বলেই আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন তিনি। মেয়েটি নির্বাক। যেনো ভাষা হারাইয়া ফেলছে।

ঐ দিনেই মেয়েটিকে নিয়ে তার বড় ভাই চলে যায়। যাওয়ার আগে জানাইয়া যায়, মেয়েটার স্বামী দেখতে অনেকটা আমার মতোই। মাস খানেক আগে তার স্বামী রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। বছর খানেকও হয় নি তাদের বিয়ে হয়েছিলো। স্বামীর মৃত্যুর পর সে এই ঘটনা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। ক্ষণে ক্ষণেই পাগলের মতো আচরণ শুরু করতো। বলতো তার স্বামী মরে নাই। তার কাছে যেতে হবে তাকে। বেঁচে থাকতে তারা মোহাম্মদপুরেই থাকতো। আজ সকালে সবাই ঘুম থেকে উঠার পর হঠাৎ টের পায় সে নেই। এর পর থেকে সম্ভাব্য সকল স্থানে তাকে সারাদিন খোঁজা হৈছে। কিন্তু সে যে ঠিকানা ভুল করে মোহাম্মদপুরে আমার বাসায় এসে উঠবে এটা কে জানতো!

Read More

2 মন্তব্য(গুলি):

মুঠোভর্তি সোনার আলো ছড়িয়েছি ভাতের থালায়
তোমার গোলায় আজ তাই বাতাবি নেবুর ঘ্রাণ

আর দুই বেলা ভাতের মৌসুমে বয়ে যাওয়া বাতাস
আমাদের গায়ে লাগেনি
তার কাছে মিঠেকড়া গল্প শুনতে গিয়ে আমরা তাই
ভুলে আছি নিজেদের পরিচয়

এবার বোধহয় তাই মুছে গেছে পাপ পূণ্যের হিসাব
ভাতের ইতিহাসে সে এক অনুজ্জ্বল অধ্যায়

        : তুমি তার নাম ঠিকানা লিখে রাখো-
          আমি মৃত্যু পরোয়ানা পৌঁছে দিবো

ভাতের ভবিষ্যৎ

at শনিবার, আগস্ট ২৫, ২০১২  |  No comments

মুঠোভর্তি সোনার আলো ছড়িয়েছি ভাতের থালায়
তোমার গোলায় আজ তাই বাতাবি নেবুর ঘ্রাণ

আর দুই বেলা ভাতের মৌসুমে বয়ে যাওয়া বাতাস
আমাদের গায়ে লাগেনি
তার কাছে মিঠেকড়া গল্প শুনতে গিয়ে আমরা তাই
ভুলে আছি নিজেদের পরিচয়

এবার বোধহয় তাই মুছে গেছে পাপ পূণ্যের হিসাব
ভাতের ইতিহাসে সে এক অনুজ্জ্বল অধ্যায়

        : তুমি তার নাম ঠিকানা লিখে রাখো-
          আমি মৃত্যু পরোয়ানা পৌঁছে দিবো

Read More

0 মন্তব্য(গুলি):

রবিবার, ৫ আগস্ট, ২০১২


আজ বন্ধু দিবসকে সামনে রেখে বন্ধুরা তাদের ওয়াল ভরে দিচ্ছে বন্ধুত্বের স্মৃতি রোমন্থন করে। স্মৃতি রোমন্থন আমি খুব একটা পছন্দ করি না। যে সকল বন্ধুদের আমি মিস করি, তাদের কাছে রাখার চেষ্টা করি। ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে বলে আশে পাশে এনে রাখার চেষ্টা করি যাতে তার সাথে চাইলেই দেখা করা সম্ভব হয়। কিন্তু চাইলেই কি আর সবাইকে কাছে আনা যায়? সবাইকে যেমন কাছে এনে রাখা যায় না তেমন চাইলেও তার কাছে যাওয়া যায় না। তেমন এক বন্ধুর কথাই আজ সবচে বেশী মনে পড়ছে। তার নাম শওকত হোসেন।

শওকতের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো ১৯৯৮ সালে যখন বাড়ি ছেড়ে প্রথম বাড়ির বাইরে পড়তে বের হলাম তখন। আমি যে প্রতিষ্ঠানে (কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ময়মনসিংহে) ক্লাস নাইনে গিয়ে ভর্তি হই, সেখানে সেও এসে ভর্তি হয়েছিলো। দুই জনেই অস্থায়ী ছাত্র হওয়ায় আমরা ক্যাম্পাসের হোস্টেলে উঠেছিলাম। তার রুম নং ছিলো ২১৪। আর আমার ২১১। ক্যাম্পাসে আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই ছিলো আমার অভিভাবক। তাই আমাকে চোখে চোখে রাখতো যেনো আমি হোস্টেল জীবনের স্বাধীনতা পেয়ে বখে যাওয়া ছেলে না হই। কিন্তু শওকতের তো তেমন কেউ ছিলো না। তার গ্রামের বাড়ি ছিলো জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানায়। পরে আমি একাধিকবার তার সুত্রে ইসলামপুর গিয়েছি।

প্রকৃত অর্থে আমার সাথে ফার্স্ট ইয়ারে (ক্লাস নাইনকে সেখানে তাই বলা হতো) সখ্যতা খুব একটা জমেনি। জমেছিলো ক্লাস টেন এ এসে। ঐ সময় আমাদের উড়নচণ্ডি জীবন শুরু হয়। তার ডিপার্টমেন্ট ছিলো অটোমোবাইল। আমার ইলেকট্রিক্যাল। আমাগো সাথে ছিলো আমার ডিপার্টমেন্টের সুজন চন্দ্র দাশ। তার সাথে এখনো আমার যোগাযোগ আছে। আর ছিলো তার ডিপার্টম্যান্টের মামুন। ভৈরব, কিশোরগঞ্জের। আমরা চারজন মিলে ক্যাম্পাসের হেন কোনও অপকর্ম নাই করি নাই।

হোস্টেলের পুকুর থেকে মাছ চুরি, হোস্টেলের নারিকেল গাছ থেকে ডাব চুরি আর কলার বাগান থেকে কলার ছড়ি চুরি করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিলো। মনে আছে একবার আমরা হোস্টেলের চারপাশের প্রায় সতেরোটা নারকেল গাছ থেকে প্রায় শতাধিক ডাব পেরেছিলাম। আমরা চারজন খেয়ে শেষ করতে না পেরে শেষে এটা দিয়ে ঘর মুছেছিলাম। অবশ্য কিছু কিছু অন্য ছেলেদেরও দিয়েছিলাম। তবে কেবল যাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ভালো তাদেরকেই কেবল।

শওকত নিজেকে সৈকত বলতো।আমরা ময়মনসিংহ শহরের সব সিনেমাহলগুলোতে সিনেমা দেখতাম। সিনেমা শুরু হতো রাত ৯.৩০ মিনিটে। শেষ হৈতো বারোটা ৩০ এ। হোস্টেলে আসতে আসতে ১.৩০টা বেজে যেতো। দশটার পর হোস্টেলে ঢুকার মেইন গেইট বন্ধ করে দিতো হোস্টেল সুপার। আর বিকল্প পদ্ধতিতে হোস্টেলে ঢুকার পথ খুঁজে বের করছিলো সৈকতই। চারজন এক সাথে রিকশায় উঠতাম। সৈকত আর আমি রিকশার উপরিভাগে। ক্লাস শেষে শহরের ঐ অঞ্চলটা মানে মাসকান্দা এলাকাটা এখনকার মতো তখনও এত শহুরে হয়ে না উঠায় আমরা গ্রামে বেড় হইতাম ঘুরতে। প্রতিদিন এক সময় আমরা সিদ্ধান্ত নেই ময়মনসিংহ শহরের সব রাস্তাগুলো আমরা পায়ে হেটে ঘুরবো। মূলত: চিনে নেওয়ার লক্ষ্য থেকেই এই সিদ্ধান্ত। আমরা শুরু করেছিলাম। কিন্তু শেষ করতে পারিনি।

সৈকতের মার্শাল আর্টের খুব শখ ছিলো। তার ওয়ারড্রবে সব সময়ই একটা চেইনস্টিক থাকতো। সে সপ্তাহে দুইদিন ক্যাম্পাসে মার্শাল আর্টের ক্লাস হৈতো ঐখানে ভর্তি হইলো। কিছুদিন পরে শুনলাম তার মার্শাল আর্টের পরীক্ষা।সে ইয়েলো বেল্ট থেকে না গ্রীন, না গ্রীন থেকে ইয়েলো হয় মনে নাই তেমন একটা বেল্ট অর্জন করলো। আমার তারে ঈর্ষা হৈতো। কিন্তু কিছু কইতে পারতাম না। আমাদের হোস্টেলগুলোর রুম গুলোতে সিলিং ফ্যান লাগানোর ব্যবস্থা ছিলো না। গরম পরলে আমরা কাথা বালিশ নিয়ে তিনতলা হোস্টেলের ছাদে চলে যাইতাম। এই বুদ্ধিও সৈকতের আবিষ্কার। একদিন আমরা প্রায় সতেরো আঠারো জন অসম্ভব গরমে সিদ্ধ হয়ে ঘুমানোর জন্য চাদর আর বালিশ নিয়ে ছাদে ঘুমাইতে যাই। শেষ রাত্রীতে বৃষ্টি আমাদের অর্ধেক ভিজিয়ে দেয়। সেইসব স্মৃতি হারিয়ে যাবে এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথেই। তখন তা এতটা আপন করে ভাবিই নি। তারপরও একটা নোটবুকে অনেক বন্ধুরই বাড়ির ঠিকানা রাখা হয়েছিলো। সেই নোটবুক কবে যে কোথায় হারিয়েগেছে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর মতো। সেই ৯৮/৯৯ সনে মোবাইল ফোন বিষয়টা আমাদের সবারকাছেই প্রায় অপরিচিত ছিলো। কারণ আমাদের আসে পাশে আমরা কারও কাছে দেখিনি বস্তুটাকে। তাই যোগাযোগটা সহজ হয়নি আমাদের।

এসএসসির পরও সৈকতের সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছিলো, আমার বাড়িতে টিএন্ডটি ফোনের বদৌলতে সে আমাকে ফোন করতে পারতো। আর চিঠি লিখতো সে, আমিও জবাব দিতাম। শেষবার তার বাড়ি যখন যাই তখন তুমুল বর্ষা। ইসলামপুর স্টেশনে নেমে প্লাটফরম অতিক্রম করে সোজা বাজারে ঢুকে পরা যায়। কিন্তু আমি স্টেশনের গেট দিতে বেড় হতে গিয়ে অনেক পথ ঘুরে তারপর তাদের বাড়ি হাজির হয়েছিলাম। তখন সে এইচএসসি পরীক্ষা দেয়। আর কি যেনো একটা রোগ তার ঠিকঠাক মতো বলেনি। হাসপাতাল পার হয়ে তাদের বাড়িতে সেবারই আমার শেষ যাত্রা। তার পর তার সাথে আমার আর যোগাযোগ হয় নি। এইচএসসির রেজাল্ট ভালো করতে না পারায় আমি কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারিনি। তাই অনার্স পড়তে আমাকে ভর্তি হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি পড়াশোনা, রাজনীতি, কবিতা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ব্যাপক ব্যস্ত হয়ে পরি। তার খোঁজ নিতে পারিনি। ভুল করেছি বন্ধু। পারলে এই ভুল আর কারো সাথে কারবো না। অনার্স পরীক্ষা দিয়ে আমি কাজের খোঁজে ঢাকা চলে আসি। শুরু হয় নতুন ব্যস্ততা। এক সময় মাস্টার্স পরীক্ষার জন্য আবার ময়মনসিংহে যাই। তার আগে থেকেই সৈকতের ব্যাপারে কথা হৈতো। কোনও খোঁজ রাখতে পারিনি আমরা। নিজেরা কেবল দুঃখপ্রকাশই করি।

মাস্টার্স পরীক্ষার জন্য যখন ময়মনসিংহ গেলাম হঠাৎ এক সপ্তাহ পরীক্ষা পিছিয়ে গেলো। আমার মনে হলো আমি এই সুযোগে বন্ধুটার খোঁজ নিয়ে আসি। একদিন সন্ধ্যায় জামালপুর বাহাদুরাবাদঘাট মুখি ট্রেনের টিকিট করে বসি।পরদিন সকাল ১০টায় ট্রেন। আমার ভেতরে উত্তেজনা। বন্ধুর খোঁজ নিতে যাচ্ছি। ট্রেন গিয়ে থামে ইসলামপুর স্টেশনে। আমি বন্ধুর বাবার হোমিওপ্যাথী ওষুধের দোকান খুঁজি। ঐখানে নতুন হোমিওপ্যাথীর দোকান খুঁজে পাই। জিজ্ঞেস করি এখানে বাহাদুর হোমিও হল ছিলো না? ঐ লোক কিছুটা বিরক্তিকর চোখে আমার দিকে তাকায়। বলে কোত্থেকে আসছেন? বলি ময়মনসিংহ। তারা তো নাই- জবাব দেয়। শোনায় অন্য কাহিনী। সে আমার বন্ধুর না। সে আমার বন্ধুর বাবার। সে গল্প এখানে না বলি। আরও বিস্তারিত খোঁজ নিতে গিয়ে তার ভাইয়ের ইলেকট্রিকের দোকান আবিষ্কার করি বাজারেই। তার ভাই শহরে নাই। চাকরি করে বাহাদুরাবাদঘাট পৌরসভায়। তার জন্য অপেক্ষা করি। তিনি আসেন। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে তিনি এসেই ঠান্ডা পানিয় আনান, আর আনান বিস্কিট। আমি প্রচণ্ড ক্ষুধার্থ। কিন্তু তারচেয়ে বেশী ক্ষুধার্থ আমি বন্ধুর খবর জানার জন্য। তার কাছ থেকে জানলাম বন্ধু আমার আজ থেকে ৬ বছর পূর্বে দুটো কিডনী ড্যামেজ হয়ে মারা গেছে। কত সহজেই বলে ফেললাম। ফেরার সময় আমার চোখে জল এসেছিলো কিনা মনে নেই। তবে ট্রেনে করে আসার সময় হয়তো কিছুটা এসেছিলো। সামনের সীটের বৃদ্ধ যাত্রীটি আমার চোখের জল দেখে হয়তো আশ্চর্য হয়েছিলো। আমি শুধু মনে মনে বলেছি, বন্ধু তোকে এভাবে হারাতে চাই নি আমি। আমি চাই তুই আমার মাঝ দিয়ে বেঁচে থাক। বেঁচে থাক তুই।

বেঁচে থাক বন্ধু

at রবিবার, আগস্ট ০৫, ২০১২  |  No comments


আজ বন্ধু দিবসকে সামনে রেখে বন্ধুরা তাদের ওয়াল ভরে দিচ্ছে বন্ধুত্বের স্মৃতি রোমন্থন করে। স্মৃতি রোমন্থন আমি খুব একটা পছন্দ করি না। যে সকল বন্ধুদের আমি মিস করি, তাদের কাছে রাখার চেষ্টা করি। ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে বলে আশে পাশে এনে রাখার চেষ্টা করি যাতে তার সাথে চাইলেই দেখা করা সম্ভব হয়। কিন্তু চাইলেই কি আর সবাইকে কাছে আনা যায়? সবাইকে যেমন কাছে এনে রাখা যায় না তেমন চাইলেও তার কাছে যাওয়া যায় না। তেমন এক বন্ধুর কথাই আজ সবচে বেশী মনে পড়ছে। তার নাম শওকত হোসেন।

শওকতের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো ১৯৯৮ সালে যখন বাড়ি ছেড়ে প্রথম বাড়ির বাইরে পড়তে বের হলাম তখন। আমি যে প্রতিষ্ঠানে (কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ময়মনসিংহে) ক্লাস নাইনে গিয়ে ভর্তি হই, সেখানে সেও এসে ভর্তি হয়েছিলো। দুই জনেই অস্থায়ী ছাত্র হওয়ায় আমরা ক্যাম্পাসের হোস্টেলে উঠেছিলাম। তার রুম নং ছিলো ২১৪। আর আমার ২১১। ক্যাম্পাসে আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই ছিলো আমার অভিভাবক। তাই আমাকে চোখে চোখে রাখতো যেনো আমি হোস্টেল জীবনের স্বাধীনতা পেয়ে বখে যাওয়া ছেলে না হই। কিন্তু শওকতের তো তেমন কেউ ছিলো না। তার গ্রামের বাড়ি ছিলো জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানায়। পরে আমি একাধিকবার তার সুত্রে ইসলামপুর গিয়েছি।

প্রকৃত অর্থে আমার সাথে ফার্স্ট ইয়ারে (ক্লাস নাইনকে সেখানে তাই বলা হতো) সখ্যতা খুব একটা জমেনি। জমেছিলো ক্লাস টেন এ এসে। ঐ সময় আমাদের উড়নচণ্ডি জীবন শুরু হয়। তার ডিপার্টমেন্ট ছিলো অটোমোবাইল। আমার ইলেকট্রিক্যাল। আমাগো সাথে ছিলো আমার ডিপার্টমেন্টের সুজন চন্দ্র দাশ। তার সাথে এখনো আমার যোগাযোগ আছে। আর ছিলো তার ডিপার্টম্যান্টের মামুন। ভৈরব, কিশোরগঞ্জের। আমরা চারজন মিলে ক্যাম্পাসের হেন কোনও অপকর্ম নাই করি নাই।

হোস্টেলের পুকুর থেকে মাছ চুরি, হোস্টেলের নারিকেল গাছ থেকে ডাব চুরি আর কলার বাগান থেকে কলার ছড়ি চুরি করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিলো। মনে আছে একবার আমরা হোস্টেলের চারপাশের প্রায় সতেরোটা নারকেল গাছ থেকে প্রায় শতাধিক ডাব পেরেছিলাম। আমরা চারজন খেয়ে শেষ করতে না পেরে শেষে এটা দিয়ে ঘর মুছেছিলাম। অবশ্য কিছু কিছু অন্য ছেলেদেরও দিয়েছিলাম। তবে কেবল যাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ভালো তাদেরকেই কেবল।

শওকত নিজেকে সৈকত বলতো।আমরা ময়মনসিংহ শহরের সব সিনেমাহলগুলোতে সিনেমা দেখতাম। সিনেমা শুরু হতো রাত ৯.৩০ মিনিটে। শেষ হৈতো বারোটা ৩০ এ। হোস্টেলে আসতে আসতে ১.৩০টা বেজে যেতো। দশটার পর হোস্টেলে ঢুকার মেইন গেইট বন্ধ করে দিতো হোস্টেল সুপার। আর বিকল্প পদ্ধতিতে হোস্টেলে ঢুকার পথ খুঁজে বের করছিলো সৈকতই। চারজন এক সাথে রিকশায় উঠতাম। সৈকত আর আমি রিকশার উপরিভাগে। ক্লাস শেষে শহরের ঐ অঞ্চলটা মানে মাসকান্দা এলাকাটা এখনকার মতো তখনও এত শহুরে হয়ে না উঠায় আমরা গ্রামে বেড় হইতাম ঘুরতে। প্রতিদিন এক সময় আমরা সিদ্ধান্ত নেই ময়মনসিংহ শহরের সব রাস্তাগুলো আমরা পায়ে হেটে ঘুরবো। মূলত: চিনে নেওয়ার লক্ষ্য থেকেই এই সিদ্ধান্ত। আমরা শুরু করেছিলাম। কিন্তু শেষ করতে পারিনি।

সৈকতের মার্শাল আর্টের খুব শখ ছিলো। তার ওয়ারড্রবে সব সময়ই একটা চেইনস্টিক থাকতো। সে সপ্তাহে দুইদিন ক্যাম্পাসে মার্শাল আর্টের ক্লাস হৈতো ঐখানে ভর্তি হইলো। কিছুদিন পরে শুনলাম তার মার্শাল আর্টের পরীক্ষা।সে ইয়েলো বেল্ট থেকে না গ্রীন, না গ্রীন থেকে ইয়েলো হয় মনে নাই তেমন একটা বেল্ট অর্জন করলো। আমার তারে ঈর্ষা হৈতো। কিন্তু কিছু কইতে পারতাম না। আমাদের হোস্টেলগুলোর রুম গুলোতে সিলিং ফ্যান লাগানোর ব্যবস্থা ছিলো না। গরম পরলে আমরা কাথা বালিশ নিয়ে তিনতলা হোস্টেলের ছাদে চলে যাইতাম। এই বুদ্ধিও সৈকতের আবিষ্কার। একদিন আমরা প্রায় সতেরো আঠারো জন অসম্ভব গরমে সিদ্ধ হয়ে ঘুমানোর জন্য চাদর আর বালিশ নিয়ে ছাদে ঘুমাইতে যাই। শেষ রাত্রীতে বৃষ্টি আমাদের অর্ধেক ভিজিয়ে দেয়। সেইসব স্মৃতি হারিয়ে যাবে এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথেই। তখন তা এতটা আপন করে ভাবিই নি। তারপরও একটা নোটবুকে অনেক বন্ধুরই বাড়ির ঠিকানা রাখা হয়েছিলো। সেই নোটবুক কবে যে কোথায় হারিয়েগেছে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর মতো। সেই ৯৮/৯৯ সনে মোবাইল ফোন বিষয়টা আমাদের সবারকাছেই প্রায় অপরিচিত ছিলো। কারণ আমাদের আসে পাশে আমরা কারও কাছে দেখিনি বস্তুটাকে। তাই যোগাযোগটা সহজ হয়নি আমাদের।

এসএসসির পরও সৈকতের সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছিলো, আমার বাড়িতে টিএন্ডটি ফোনের বদৌলতে সে আমাকে ফোন করতে পারতো। আর চিঠি লিখতো সে, আমিও জবাব দিতাম। শেষবার তার বাড়ি যখন যাই তখন তুমুল বর্ষা। ইসলামপুর স্টেশনে নেমে প্লাটফরম অতিক্রম করে সোজা বাজারে ঢুকে পরা যায়। কিন্তু আমি স্টেশনের গেট দিতে বেড় হতে গিয়ে অনেক পথ ঘুরে তারপর তাদের বাড়ি হাজির হয়েছিলাম। তখন সে এইচএসসি পরীক্ষা দেয়। আর কি যেনো একটা রোগ তার ঠিকঠাক মতো বলেনি। হাসপাতাল পার হয়ে তাদের বাড়িতে সেবারই আমার শেষ যাত্রা। তার পর তার সাথে আমার আর যোগাযোগ হয় নি। এইচএসসির রেজাল্ট ভালো করতে না পারায় আমি কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারিনি। তাই অনার্স পড়তে আমাকে ভর্তি হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি পড়াশোনা, রাজনীতি, কবিতা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ব্যাপক ব্যস্ত হয়ে পরি। তার খোঁজ নিতে পারিনি। ভুল করেছি বন্ধু। পারলে এই ভুল আর কারো সাথে কারবো না। অনার্স পরীক্ষা দিয়ে আমি কাজের খোঁজে ঢাকা চলে আসি। শুরু হয় নতুন ব্যস্ততা। এক সময় মাস্টার্স পরীক্ষার জন্য আবার ময়মনসিংহে যাই। তার আগে থেকেই সৈকতের ব্যাপারে কথা হৈতো। কোনও খোঁজ রাখতে পারিনি আমরা। নিজেরা কেবল দুঃখপ্রকাশই করি।

মাস্টার্স পরীক্ষার জন্য যখন ময়মনসিংহ গেলাম হঠাৎ এক সপ্তাহ পরীক্ষা পিছিয়ে গেলো। আমার মনে হলো আমি এই সুযোগে বন্ধুটার খোঁজ নিয়ে আসি। একদিন সন্ধ্যায় জামালপুর বাহাদুরাবাদঘাট মুখি ট্রেনের টিকিট করে বসি।পরদিন সকাল ১০টায় ট্রেন। আমার ভেতরে উত্তেজনা। বন্ধুর খোঁজ নিতে যাচ্ছি। ট্রেন গিয়ে থামে ইসলামপুর স্টেশনে। আমি বন্ধুর বাবার হোমিওপ্যাথী ওষুধের দোকান খুঁজি। ঐখানে নতুন হোমিওপ্যাথীর দোকান খুঁজে পাই। জিজ্ঞেস করি এখানে বাহাদুর হোমিও হল ছিলো না? ঐ লোক কিছুটা বিরক্তিকর চোখে আমার দিকে তাকায়। বলে কোত্থেকে আসছেন? বলি ময়মনসিংহ। তারা তো নাই- জবাব দেয়। শোনায় অন্য কাহিনী। সে আমার বন্ধুর না। সে আমার বন্ধুর বাবার। সে গল্প এখানে না বলি। আরও বিস্তারিত খোঁজ নিতে গিয়ে তার ভাইয়ের ইলেকট্রিকের দোকান আবিষ্কার করি বাজারেই। তার ভাই শহরে নাই। চাকরি করে বাহাদুরাবাদঘাট পৌরসভায়। তার জন্য অপেক্ষা করি। তিনি আসেন। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে তিনি এসেই ঠান্ডা পানিয় আনান, আর আনান বিস্কিট। আমি প্রচণ্ড ক্ষুধার্থ। কিন্তু তারচেয়ে বেশী ক্ষুধার্থ আমি বন্ধুর খবর জানার জন্য। তার কাছ থেকে জানলাম বন্ধু আমার আজ থেকে ৬ বছর পূর্বে দুটো কিডনী ড্যামেজ হয়ে মারা গেছে। কত সহজেই বলে ফেললাম। ফেরার সময় আমার চোখে জল এসেছিলো কিনা মনে নেই। তবে ট্রেনে করে আসার সময় হয়তো কিছুটা এসেছিলো। সামনের সীটের বৃদ্ধ যাত্রীটি আমার চোখের জল দেখে হয়তো আশ্চর্য হয়েছিলো। আমি শুধু মনে মনে বলেছি, বন্ধু তোকে এভাবে হারাতে চাই নি আমি। আমি চাই তুই আমার মাঝ দিয়ে বেঁচে থাক। বেঁচে থাক তুই।

Read More

0 মন্তব্য(গুলি):

এই সাইটের যে কোনও লেখা যে কেউ অনলাইনে ব্যবহার করতে পারবে। তবে লেখকের নাম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।

Blogger template Proudly Powered by Blogger. Arranged By: এতক্ষণে অরিন্দম