শনিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১২

নাট্য পরিচালক হিসেবে পরিচালিত রেদওয়ান রনির প্রথম চলচ্চিত্র ‘চোরাবালি’। এই নির্মাতার নাটকগুলো যেমন বিনোদনের খোরাক জুগিয়েছে, তেমন নাটকের ট্রাডিশনাল গল্পের বাইরে কিছু ব্যতিক্রম গল্পও উপহার দিয়েছে। নাট্যনির্মাতা হিসেবে রনির পথচলাটা বেশ কয়েকবছরের। বলতে গেলে তা প্রায় ছয় সাত বছরেরও বেশী। এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে এই নির্মাতা সিনেমা বানানোর স্বপ্নই লালন করেছেন কেবল। তার প্রথম ছবির সংলাপ ‘চোরাবালিতে পড়লে কেউ উঠতে পারে না’র মতোই এই সে ছবি বানানোর স্বপ্নে ছিলেন। সেই ছবি ‘চোরাবালি’। ভিডিও পাইরেসি বা টেলিভিশন প্রিমিয়ারের ধার না ধরে সিনেমাহলেই তিনি মুক্তি দিলেন। আমিও প্রিমিয়ারে যাওয়ার সুযোগ মিস করের গাটের টাকা খরচ করেই সেই ছবি দেখে এসেছি। ছবি দেখার পর এক কথায় যদি আমাকে কেউ প্রশ্ন করেন কেমন ছবি? আমি বলবো আপনার ছবিটা সিনেমা হলে দেখা উচিত। ভালো মন্দের প্রশ্ন পরে। সে আলোচনার প্রসঙ্গ আরও পরে। তার কারণ বাংলাদেশের সিনেমা শিল্পের মুমূর্ষু পরিস্থিতিতে বেঁচে উঠার সম্ভাবনা নিয়ে এই ছবি একটা মাইলফলক না হলেও বেশ বড় অবদান নিয়ে দাঁড়াবে বলেই ছবিটা আপনার দেখা উচিত। ছবিটা কেন দেখবেন? এই প্রশ্নের উত্তরগুলো আমি আগে দেই। প্রথমত ছবিটা সবার জন্য নির্মিত। দ্বিতীয়ত ছবিটা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের নবতর সূচনার সম্ভাবনাময় একটি ছবি। ছবিটিতে মিউজিক করেছেন আইয়ুব বাচ্চু ও অনপমের মতো শিল্পী। তাদের গান শোনার জন্য ছবি। কলকাতার অভিনেতা ইন্দ্রনীল অভিনয় করেছেন তার জন্য। সবার আগে যে কারণে এই ছবিটা দেখবেন, তা হলো যেই দেশে কলকাতার জঘন্য ছবিগুলো এসে বাজার দখল করতে চেষ্টা করছে, বলিউডের নজরকাড়া নায়ক-নায়িকার ছবি এসে সিনেমাহল দখল করতে চাইছে, সেই সময় বাংলাদেশের তরুণ পরিচালকের একটি ছবি। এসব কারণেই তো ছবিটা দেখাই উচিত আপনার। তাই ছবিটা দেখতেই বলবো আপনাকে। আপনি যদি এই ছবি দেখেন আগামী পাঁচ বছরে এর চেয়ে ভালো ছবি আপনি আপনার সিনেমাহলেই দেখতে পাবেন। আর তার জন্যও এই ছবি আপনাকে সিনেমাহলে গিয়েই দেখতে হবে।
এবার আসি ছবির ভেতরে। ছবির জার্নিটা ছিলো তিন বছরের। মানে ২০১০ এর শেষ দিকে রেদওয়ান রনির ঘোষণা আসে সে ছবি বানাবে। ২০১১ অতিক্রম করে ২০১২’র শেষ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এসে এই ছবি মুক্তি পেয়েছে। এই দীর্ঘ যাত্রায় রনি নিজে যে ছবির গল্প দাঁড় করিয়েছে তার বেশ কিছু জায়গায় আমার ঘোর আপত্তি আছে। প্রথমত এমন আন্ডারগ্রাউন্ড স্টোরি নিয়ে বাংলাদেশের নিয়মিত নির্মাতারা একাধিক ছবি বানিয়েছে। কিন্তু সেসব সিনেমা সিনেমার ধারে কাছেও না যাওয়ায়, রেদওয়ান রনির কাছে এই জায়গায় প্রত্যাশা আরও বেশী ছিলো। সে প্রত্যাশা পুরোপুরি পুরণ করতে পারেন নি তিনি। তবে তিনি যে পদ্ধতিতে শুরু করেছেন, তার জন্য তাঁকে সাধুবাদ। ছবির গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সুমন (ইন্দ্রনীল) একজন প্রফেশনাল খুনি। যে কিনা তার গডফাদার (শহীদুজ্জামান সেলিম) এর পোশা মানুষ। খুন করা তার কাছে ডালভাত। কারণ, বারো/তেরো বছরেই সে একাধিক খুন করেছে। প্রথম খুনটা সে করে তার মা’র ধর্ষণকারী স্থানীয় চেয়ারম্যানকে। দ্বিতীয় খুন করে বস্তির এক ড্রাগ ব্যবসায়ী তাঁর মাকে বেশ্যা বলায়। দ্বিতীয় খুনের পরই সে চলে আসে তাঁর গডফাদারের হাওলায়। তার ছত্রছায়ায় তার আর খুনের কোনও হিসাব থাকেনা তখন। এমন একজন খুনী কিনা পেছন থেকে একজন প্রেগনেন্ট মহিলাকে খুন করেই তার ১৩/১৪ বছরের খুনী জীবন থেকে বেড়িয়ে আসতে পারবে? অবিশ্বাস্য হলেও এমন ঘটনাই ঘটেছে এই ছবিতে। এই ইন্দ্রনীল এই খুনের পর থেকে ছবির গল্পে পরিবর্তন আসতে থাকে। গল্পে সে ভিলেন থেকে নায়ক হতে থাকে। যদিও ছবিতে কেন্দ্রীয় নায়ক চরিত্র বলে আসলে তেমন কাউকে পাওয়া যায় না। ইন্দ্রনীলের করা সুমন চরিত্র সিনেমার প্রথমভাগেও কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে দাঁড়াতে পারে না। যতটা দাঁড়ায় সেলিমের করা চরিত্র। ছবির অধিকাংশ সময়ই মনে হয় সুমন চরিত্রটি কেবল একটি ক্রীড়নক মাত্র। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে এসে সুমনের নায়ক হওয়ার প্রচেষ্টা দেখা যায়। দেখা যায় সে আর খুনী থাকতে চায় না। ভালো মানুষ হতে চায়। ছবির নায়িকা নাবিলার (জয়া) চরত্রিটিও তেমন চ্যালেঞ্জিং হওয়ার কথা ছিলো, ততটা চ্যালেঞ্জিং হয় নি। টেলিভিশনের নিয়মিত নিয়ম ভাঙা জয়া এখানে অনুপস্থিত। কিন্তু ছোট চরিত্র হলেও এই ছবিতে নিজের মতো শক্তি আর চমৎকারিত্ব নিয়ে হাজির হয়েছেন এটিএম সামসুজ্জামান। তাঁর ক্ষমতা তিনি পরিমিতই দেখিয়েছেন। পরিমিত অভিনয় ক্ষমতা দেখিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন সব কিছু পরিমিত হওয়াই বাঞ্ছনিয়, অতিরঞ্জিত নয়। ঠিক এই কাজটিই করেছেন অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিম। শক্তিমান অভিনেতা হিসেবে তার প্রতিষ্ঠা পরিচিতি থাকলেও সিনেমায় অভিনয়ের যে ভিন্ন একটা আবেদন আছে, তা তার অভিনয়ে পাওয়া যায় নি। বরং তার অভিনয়ে যা পাওয়া গেছে তা হলো তার অতিঅভিনয়ের বাড়াবাড়ি। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রই বলতে গেলে তা। আর তা এই অভিনেতার বাড়াবাড়ির কারণে এক প্রকার নষ্টই হয়েছে। খুব সীমিত পরিসরে চমৎকার অভিনয় করেছে হুমায়ূন সাধু। তাঁকে সাধুবাদ। ছবির প্রথম অর্ধ যখন শেষই হচ্ছে না তখন আমার মনে হচ্ছিলো ছবির গল্প অনেক বড়। আর এই গল্প দ্বিতীয়ার্ধে এসে কিনা কেমন জানি খাপছাড়া খাপছাড়া মনে হচ্ছিলো। ইন্দ্রনিলের করা চরিত্রটির ট্রান্সপোর্টেশন খুব দুর্বল। প্রকৃত অর্থে কেবল ইন্দ্রনিলকে নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যেই এই ট্রান্সপোর্টেশন। কিন্তু এই ট্রান্সপোর্টেশনটা আরও মজবুত হলে ছবি দেখে আরও উপভোগ করা যেতো। দুইঘন্টার ছবি দেখে ছবিতে সবচেয়ে বেশী যে জিনিসগুলো আমার কাছে আকর্ষনীয় মনে হয়েছে তার মাঝে হলো ইন্দ্রনীলের ফ্লাশব্যাক। এই সময়টার কালারটোন ছিলো ভিন্ন। অতীতের গল্প বলার জন্য সেপিয়া টোন ব্যবহার করেছে পরিচালক। তারচেয়ে বড় কথা এই সময়টার নির্মাণ কৌশলেই পাওয়া গেছে চলচ্চিত্রকার রেদওয়ান রনিকে। বাকি সময়টায় রনি ছিলো ট্রাডিশনাল টিভি নাট্য পরিচালকের মতোই।
এছাড়া এই ছবির সবচে বড় দুর্বলতা ছিলো সংলাপে। সংলাপ আরও কি চমৎকারই না হতে পারতো। এই আক্ষেপের সাথে আরও একটা আক্ষেপ বড় ভুগিয়েছে তা হলো ছবির কন্টিনিটি। ইন্দ্রনীলকে যে পিস্তলটা শহীদুজ্জামান সেলিম সেই কবে উপহার দিয়েছিলো এই পিস্তলটাই তার সাথে থাকার কথা। কিন্তু এই পিস্তলটার স্থলে ভিন্ন সময় ভিন্ন পিস্তল কি চোখে পড়েছে? আমি আমার পাশের দর্শককে জিজ্ঞেস করায় সেও সায় দিলো এই স্থানে। এমন ছোটখাটো বেশকিছু ভুল আছে সেগুলোকে অতিক্রম করার জন্য ছিলো চমৎকার ব্যকগ্রাউন্ড মিউজিক স্কোর। অরিজিনাল স্কোরের চেয়ে গল্পের সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর মানিয়েছে চমৎকার। আর একটা আইটেম গান? প্রাণহীন একটা মেয়ে আর একদল ছেলের শরীর দেখালেই কি আইটেম গান হয়? তাও আর গল্পের সাথে কোনও সামঞ্জস্য না রেখে হুট করে দিলেই হলো? তাহলে এই আইটেম গানটা ছবিতে ব্যবহার না করে কেবল মার্কেটিং এ ব্যবহার করলেও ছবির দর্শক আগ্রহী হতো বলে আমার মনে হয়।
ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবচে বিরক্তিকর বিষয় হৈলো ইন্দ্রনীলের লিপে শতাব্দী ওয়াদুদের কন্ঠ আর মডেল কন্যার কণ্ঠে দীপা খন্দকারের কণ্ঠ। একদমই মানায়নাই বলে মনে হৈছে আমার।
এতকিছুর পরও আমি এই পরিচালককে নিয়ে আসাবাদী। আমি চাইবো রেদওয়ান রনি নিয়মিত ছবিই বানাক। আর নাটক না বানিয়ে এর চেয়ে ভালো ছবিই বানাক। তখন একই ছবি বারবার দেখার জন্য আমিই সিনেমাহলে যাবো। আমার মনে হয় এর চেয়ে আর একটু ভালো হলে আমার মতো দর্শক আরও তৈরি হবে। একই ছবি বারবার দেখার জন্য সিনেমাহলে যাবে। আর তা না হলে চলচ্চিত্র শিল্প যে অপারেশন টেবিলে এখন আছে, সেখান থেকে সে আর সুস্থ্য হয়ে ফিরে আসতে পারবে না। আর ভালো ছবি হলে চলচ্চিত্র উঠে দাঁড়াবে, হাসবে খেলবে। যা খুব প্রয়োজন আমাদের জন্য।

‘চোরাবালি’ দর্শনের ভুল-ভাল

at শনিবার, ডিসেম্বর ২২, ২০১২  |  1 comment

নাট্য পরিচালক হিসেবে পরিচালিত রেদওয়ান রনির প্রথম চলচ্চিত্র ‘চোরাবালি’। এই নির্মাতার নাটকগুলো যেমন বিনোদনের খোরাক জুগিয়েছে, তেমন নাটকের ট্রাডিশনাল গল্পের বাইরে কিছু ব্যতিক্রম গল্পও উপহার দিয়েছে। নাট্যনির্মাতা হিসেবে রনির পথচলাটা বেশ কয়েকবছরের। বলতে গেলে তা প্রায় ছয় সাত বছরেরও বেশী। এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে এই নির্মাতা সিনেমা বানানোর স্বপ্নই লালন করেছেন কেবল। তার প্রথম ছবির সংলাপ ‘চোরাবালিতে পড়লে কেউ উঠতে পারে না’র মতোই এই সে ছবি বানানোর স্বপ্নে ছিলেন। সেই ছবি ‘চোরাবালি’। ভিডিও পাইরেসি বা টেলিভিশন প্রিমিয়ারের ধার না ধরে সিনেমাহলেই তিনি মুক্তি দিলেন। আমিও প্রিমিয়ারে যাওয়ার সুযোগ মিস করের গাটের টাকা খরচ করেই সেই ছবি দেখে এসেছি। ছবি দেখার পর এক কথায় যদি আমাকে কেউ প্রশ্ন করেন কেমন ছবি? আমি বলবো আপনার ছবিটা সিনেমা হলে দেখা উচিত। ভালো মন্দের প্রশ্ন পরে। সে আলোচনার প্রসঙ্গ আরও পরে। তার কারণ বাংলাদেশের সিনেমা শিল্পের মুমূর্ষু পরিস্থিতিতে বেঁচে উঠার সম্ভাবনা নিয়ে এই ছবি একটা মাইলফলক না হলেও বেশ বড় অবদান নিয়ে দাঁড়াবে বলেই ছবিটা আপনার দেখা উচিত। ছবিটা কেন দেখবেন? এই প্রশ্নের উত্তরগুলো আমি আগে দেই। প্রথমত ছবিটা সবার জন্য নির্মিত। দ্বিতীয়ত ছবিটা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের নবতর সূচনার সম্ভাবনাময় একটি ছবি। ছবিটিতে মিউজিক করেছেন আইয়ুব বাচ্চু ও অনপমের মতো শিল্পী। তাদের গান শোনার জন্য ছবি। কলকাতার অভিনেতা ইন্দ্রনীল অভিনয় করেছেন তার জন্য। সবার আগে যে কারণে এই ছবিটা দেখবেন, তা হলো যেই দেশে কলকাতার জঘন্য ছবিগুলো এসে বাজার দখল করতে চেষ্টা করছে, বলিউডের নজরকাড়া নায়ক-নায়িকার ছবি এসে সিনেমাহল দখল করতে চাইছে, সেই সময় বাংলাদেশের তরুণ পরিচালকের একটি ছবি। এসব কারণেই তো ছবিটা দেখাই উচিত আপনার। তাই ছবিটা দেখতেই বলবো আপনাকে। আপনি যদি এই ছবি দেখেন আগামী পাঁচ বছরে এর চেয়ে ভালো ছবি আপনি আপনার সিনেমাহলেই দেখতে পাবেন। আর তার জন্যও এই ছবি আপনাকে সিনেমাহলে গিয়েই দেখতে হবে।
এবার আসি ছবির ভেতরে। ছবির জার্নিটা ছিলো তিন বছরের। মানে ২০১০ এর শেষ দিকে রেদওয়ান রনির ঘোষণা আসে সে ছবি বানাবে। ২০১১ অতিক্রম করে ২০১২’র শেষ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এসে এই ছবি মুক্তি পেয়েছে। এই দীর্ঘ যাত্রায় রনি নিজে যে ছবির গল্প দাঁড় করিয়েছে তার বেশ কিছু জায়গায় আমার ঘোর আপত্তি আছে। প্রথমত এমন আন্ডারগ্রাউন্ড স্টোরি নিয়ে বাংলাদেশের নিয়মিত নির্মাতারা একাধিক ছবি বানিয়েছে। কিন্তু সেসব সিনেমা সিনেমার ধারে কাছেও না যাওয়ায়, রেদওয়ান রনির কাছে এই জায়গায় প্রত্যাশা আরও বেশী ছিলো। সে প্রত্যাশা পুরোপুরি পুরণ করতে পারেন নি তিনি। তবে তিনি যে পদ্ধতিতে শুরু করেছেন, তার জন্য তাঁকে সাধুবাদ। ছবির গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সুমন (ইন্দ্রনীল) একজন প্রফেশনাল খুনি। যে কিনা তার গডফাদার (শহীদুজ্জামান সেলিম) এর পোশা মানুষ। খুন করা তার কাছে ডালভাত। কারণ, বারো/তেরো বছরেই সে একাধিক খুন করেছে। প্রথম খুনটা সে করে তার মা’র ধর্ষণকারী স্থানীয় চেয়ারম্যানকে। দ্বিতীয় খুন করে বস্তির এক ড্রাগ ব্যবসায়ী তাঁর মাকে বেশ্যা বলায়। দ্বিতীয় খুনের পরই সে চলে আসে তাঁর গডফাদারের হাওলায়। তার ছত্রছায়ায় তার আর খুনের কোনও হিসাব থাকেনা তখন। এমন একজন খুনী কিনা পেছন থেকে একজন প্রেগনেন্ট মহিলাকে খুন করেই তার ১৩/১৪ বছরের খুনী জীবন থেকে বেড়িয়ে আসতে পারবে? অবিশ্বাস্য হলেও এমন ঘটনাই ঘটেছে এই ছবিতে। এই ইন্দ্রনীল এই খুনের পর থেকে ছবির গল্পে পরিবর্তন আসতে থাকে। গল্পে সে ভিলেন থেকে নায়ক হতে থাকে। যদিও ছবিতে কেন্দ্রীয় নায়ক চরিত্র বলে আসলে তেমন কাউকে পাওয়া যায় না। ইন্দ্রনীলের করা সুমন চরিত্র সিনেমার প্রথমভাগেও কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে দাঁড়াতে পারে না। যতটা দাঁড়ায় সেলিমের করা চরিত্র। ছবির অধিকাংশ সময়ই মনে হয় সুমন চরিত্রটি কেবল একটি ক্রীড়নক মাত্র। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে এসে সুমনের নায়ক হওয়ার প্রচেষ্টা দেখা যায়। দেখা যায় সে আর খুনী থাকতে চায় না। ভালো মানুষ হতে চায়। ছবির নায়িকা নাবিলার (জয়া) চরত্রিটিও তেমন চ্যালেঞ্জিং হওয়ার কথা ছিলো, ততটা চ্যালেঞ্জিং হয় নি। টেলিভিশনের নিয়মিত নিয়ম ভাঙা জয়া এখানে অনুপস্থিত। কিন্তু ছোট চরিত্র হলেও এই ছবিতে নিজের মতো শক্তি আর চমৎকারিত্ব নিয়ে হাজির হয়েছেন এটিএম সামসুজ্জামান। তাঁর ক্ষমতা তিনি পরিমিতই দেখিয়েছেন। পরিমিত অভিনয় ক্ষমতা দেখিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন সব কিছু পরিমিত হওয়াই বাঞ্ছনিয়, অতিরঞ্জিত নয়। ঠিক এই কাজটিই করেছেন অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিম। শক্তিমান অভিনেতা হিসেবে তার প্রতিষ্ঠা পরিচিতি থাকলেও সিনেমায় অভিনয়ের যে ভিন্ন একটা আবেদন আছে, তা তার অভিনয়ে পাওয়া যায় নি। বরং তার অভিনয়ে যা পাওয়া গেছে তা হলো তার অতিঅভিনয়ের বাড়াবাড়ি। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রই বলতে গেলে তা। আর তা এই অভিনেতার বাড়াবাড়ির কারণে এক প্রকার নষ্টই হয়েছে। খুব সীমিত পরিসরে চমৎকার অভিনয় করেছে হুমায়ূন সাধু। তাঁকে সাধুবাদ। ছবির প্রথম অর্ধ যখন শেষই হচ্ছে না তখন আমার মনে হচ্ছিলো ছবির গল্প অনেক বড়। আর এই গল্প দ্বিতীয়ার্ধে এসে কিনা কেমন জানি খাপছাড়া খাপছাড়া মনে হচ্ছিলো। ইন্দ্রনিলের করা চরিত্রটির ট্রান্সপোর্টেশন খুব দুর্বল। প্রকৃত অর্থে কেবল ইন্দ্রনিলকে নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যেই এই ট্রান্সপোর্টেশন। কিন্তু এই ট্রান্সপোর্টেশনটা আরও মজবুত হলে ছবি দেখে আরও উপভোগ করা যেতো। দুইঘন্টার ছবি দেখে ছবিতে সবচেয়ে বেশী যে জিনিসগুলো আমার কাছে আকর্ষনীয় মনে হয়েছে তার মাঝে হলো ইন্দ্রনীলের ফ্লাশব্যাক। এই সময়টার কালারটোন ছিলো ভিন্ন। অতীতের গল্প বলার জন্য সেপিয়া টোন ব্যবহার করেছে পরিচালক। তারচেয়ে বড় কথা এই সময়টার নির্মাণ কৌশলেই পাওয়া গেছে চলচ্চিত্রকার রেদওয়ান রনিকে। বাকি সময়টায় রনি ছিলো ট্রাডিশনাল টিভি নাট্য পরিচালকের মতোই।
এছাড়া এই ছবির সবচে বড় দুর্বলতা ছিলো সংলাপে। সংলাপ আরও কি চমৎকারই না হতে পারতো। এই আক্ষেপের সাথে আরও একটা আক্ষেপ বড় ভুগিয়েছে তা হলো ছবির কন্টিনিটি। ইন্দ্রনীলকে যে পিস্তলটা শহীদুজ্জামান সেলিম সেই কবে উপহার দিয়েছিলো এই পিস্তলটাই তার সাথে থাকার কথা। কিন্তু এই পিস্তলটার স্থলে ভিন্ন সময় ভিন্ন পিস্তল কি চোখে পড়েছে? আমি আমার পাশের দর্শককে জিজ্ঞেস করায় সেও সায় দিলো এই স্থানে। এমন ছোটখাটো বেশকিছু ভুল আছে সেগুলোকে অতিক্রম করার জন্য ছিলো চমৎকার ব্যকগ্রাউন্ড মিউজিক স্কোর। অরিজিনাল স্কোরের চেয়ে গল্পের সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর মানিয়েছে চমৎকার। আর একটা আইটেম গান? প্রাণহীন একটা মেয়ে আর একদল ছেলের শরীর দেখালেই কি আইটেম গান হয়? তাও আর গল্পের সাথে কোনও সামঞ্জস্য না রেখে হুট করে দিলেই হলো? তাহলে এই আইটেম গানটা ছবিতে ব্যবহার না করে কেবল মার্কেটিং এ ব্যবহার করলেও ছবির দর্শক আগ্রহী হতো বলে আমার মনে হয়।
ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবচে বিরক্তিকর বিষয় হৈলো ইন্দ্রনীলের লিপে শতাব্দী ওয়াদুদের কন্ঠ আর মডেল কন্যার কণ্ঠে দীপা খন্দকারের কণ্ঠ। একদমই মানায়নাই বলে মনে হৈছে আমার।
এতকিছুর পরও আমি এই পরিচালককে নিয়ে আসাবাদী। আমি চাইবো রেদওয়ান রনি নিয়মিত ছবিই বানাক। আর নাটক না বানিয়ে এর চেয়ে ভালো ছবিই বানাক। তখন একই ছবি বারবার দেখার জন্য আমিই সিনেমাহলে যাবো। আমার মনে হয় এর চেয়ে আর একটু ভালো হলে আমার মতো দর্শক আরও তৈরি হবে। একই ছবি বারবার দেখার জন্য সিনেমাহলে যাবে। আর তা না হলে চলচ্চিত্র শিল্প যে অপারেশন টেবিলে এখন আছে, সেখান থেকে সে আর সুস্থ্য হয়ে ফিরে আসতে পারবে না। আর ভালো ছবি হলে চলচ্চিত্র উঠে দাঁড়াবে, হাসবে খেলবে। যা খুব প্রয়োজন আমাদের জন্য।

Read More

1 মন্তব্য(গুলি):

এই সাইটের যে কোনও লেখা যে কেউ অনলাইনে ব্যবহার করতে পারবে। তবে লেখকের নাম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।

Blogger template Proudly Powered by Blogger. Arranged By: এতক্ষণে অরিন্দম