রবিবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৩

বাংলাদেশের ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর একটা বেশ ভালো ভূমিকা আছে। এ কথা নিশ্চয়ই কেউ অস্বীকার করবে না। আমিও করি না। আমি বরং এক কাঠি সরেশ হয়ে তাকে একটা ‘বিপ্লবী’র স্থানে দেখতে চাই। আর সেই বিপ্লবটা সেই ক্ষেত্রে, যখন বাংলাদেশের দর্শকরা ইটিভি বাংলা ছাড়া আর হাতে গোনা কয়েকজন টিভি নাট্যনির্দেশকের নাটক ছাড়া আর কিছুই বুঝতো না, তখন তিনি নতুন জানালা খোলে দিয়েছিলেন। তার টিভি নাটক মানুষ এক সময়ের ‘অয়োময়’ ‘সংসপ্তক’ এর মতো নাটক যেভাবে দেখতো ঠিক সেভাবে হয়তো দেখতো না, কিন্তু তার নাটক মানুষ উৎসব সহকারে দেখতো। এখন তিনি আর নাটক বানান না, সিনেমা বানান। একজন নির্মাতার এইটাই চূড়ান্ত পরিচয় ও অবস্থানের স্থান। তার জন্যও তিনি সেলুট পাওয়ার দাবি রাখেন। সেইটুক আমি তাকে দিতে চাই এবং তা আমার মন থেকে তিনি অকুণ্ঠভাবেই পেয়ে থাকেন। তাঁর চতুর্থ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘টেলিভিশন’। এর আগে তিনি তিন তিনটি ছবি নির্মাণ করেছেন। দর্শক সমালোচকদের কাছে প্রশংসা ও সমালোচনা তিনি দুটোই পেয়েছেন। আমার ব্যক্তিগত অবজারভেশন বলে প্রশংসা পেলে তিনি আহ্লাদে গদগদ হয়ে যান না, খুশী হন (প্রশংসা কে না পছন্দ করে?)। আবার সমালোচনা পেলে তিনি সেটাও যে খুব বিরক্ত হন তা না, তার প্রতিবাদের ভাষা অন্য রকম হয়ে গিয়ে একটা সিনেমাও হয়ে যেতে পারে। যার প্রমাণ আমরা ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ এর প্রকাশিত ডিভিডিতে দেখেছি।
সে যাই হোক, সমালোচনাকে গ্রহণযোগ্যভাবে দেখতে না পারলে তাকে আমি ততটা গুরুত্ব দিতে রাজি না। যে কাজ করতে তার সমালোচনা হবেই। যদি সমালোচনা গ্রহণ করতে পারেন, তবেই উন্নতি হবে। নইলে যা আছে তাই থাকবে, বরং অবনতিও হতে পারে। এই কথাগুলো বলা এ কারণে যে, সরয়ার ফারুকির তৃতীয় ছবি যখন মুক্তি পায়, তখন প্রয়াত নির্মাতা তারেক মাসুদ বলেছিলেন, দান দান তিন দানে যেমন আমরা সেরাটা প্রত্যাশা করি, সরয়ার এর কাছেও তাই প্রত্যাশা করি। তবে সেই ছবি দেখার পর তারেক মাসুদের প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিলো তা আমার জানা নাই। তাই আমি ঠিক এটা বলতে পারছিনা তৃতীয় দানটা কি তিনি পুরনো দানগুলোর লাভ-ক্ষতি পুষিয়ে দিয়েছিলেন কিনা। এইখানে আমার সন্দেহ রয়েছে। কারণ সেই তৃতীয় দান অতিক্রম করে এখন চতুর্থ দান-এ গিয়ে পরেছেন তিনি। একজন চলচ্চিত্রকার যদি তার চতুর্থ ছবিতে এসেও আশ্চর্য রকম কিছু করতে না পারেন, তাহলে সাধারণত ধরে নিয়ে থাকি সেই চলচ্চিত্রকার আর আশ্চর্যরকম কিছু করতে পারবে না। এ কথা সব ক্ষেত্রেই কাজে দেয় বলে ধারণা করি। যদিও ব্যতিক্রম সব সময়ই হিসেবের বাইরে।
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। ‘টেলিভিশন’ ছবিটি প্রথম প্রিমিয়ার হয়েছে ‘পুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব-২০১২’ তে। তবুও যেনতেন প্রিমিয়ার নয়, ক্লোজিং ফিল্ম হিসেবে তা প্রিমিয়ার হয়েছে। এই ছবি দেখে আমারও (অন্য অনেকের মতো- সেই দলে এই ছবির নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকিও রয়েছেন) প্রিয় নির্মাতা কিম কি দুক বলেছেন, গুড ফিল্ম। পরবর্তিতে দুবাই আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফ্যাস্টিভ্যালে এ ছবি ‘বিশেষ পুরস্কার’ পেয়েছে। এসব কারণে ‘টেলিভিশন’ ছবি নিয়ে আগ্রহ ছিলো। সেই আগ্রহ মেটাতে শুক্রবার বিকেলেই ছবিটি দেখার মনস্থির করেছিলাম। নানান কারণে তা হলো না। শনিবার সন্ধ্যার টিকিট করে সারারাত সারাদিন এর অপেক্ষায় ছিলাম। সিনেমা শুরুর সময় সিনেমার টাইটেল প্রেজেন্টেশন ভালো লেগেছে। ছবির রিভিউ পড়ার সুবাদে গল্পটি জেনে গিয়েছিলাম আগেই। যা জেনেছি তাতে মনে হৈছে এই ছবির বাংলাদেশী কোনও প্রিমিয়ার হৈলে ছবিটা দর্শকদের কাছ থেকে গ্রহণযোগ্যতা এখন যতটুকু পাচ্ছে তার চেয়ে হয়তো একটু কম পেতো। ছবির গল্প মোটামোটি এই- একজন ধর্মান্ধ চেয়ারম্যান (ধর্মভিরু বলবো না এই কারণে যে, ধর্ম ভিরুরা কখনোই ধর্ম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে না, কেবল নিজে বাঁচার জন্য ধর্মের আশ্রয় নেয়। অপরদিকে ধর্মান্ধরা ধর্মকে ঢাল করে চারপাশে ধর্মের লৌকিক জগত তৈরি করতে চায়। এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র আমার ধারণা তাই করেছে। এ কারণেই তিনি ধর্মান্ধ) নিজের গ্রামে টেলিভিশন নিষিদ্ধ করেছে। তার ধারণা টেলিভিশন দেখলেই মানুষ নষ্ট হয়ে যাবে। এই টেলিভিশনের কাছেই তাকে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হইতে হয়। মাঝখানে আছে প্রেম, সংগ্রাম, আর কিছুটা ড্রামা। এইসব বিস্তারিত বলার তেমন ইচ্ছাই হইতেছে না। ছবিটা নিয়া যে লিখতে বসছি তার কারণ অন্য। তার কারণ হৈলো এই ছবিটার প্রত্যাশার পারদ এত বেশী উড়ছিলো যে, তেমনি কইরা পারদ গইল্যা কুয়াশা হৈয়া গেছে। ছবির গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ঐ চেয়ারম্যান এতই ধর্মান্ধ যে পাসপোর্ট করতে ছবি তুলতে হবে বলে সে হজ্জ্ব করতে যেতে চায় না। কিন্তু এই ছবির দুই গল্পকার ভুলে যায় চেয়াম্যান নির্বাচন করতে হলে যে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে হয় তাতে প্রার্থীর ছবি দিতেই হবে। না দিলে মনোনয়ন বাতিল। যে গ্রামে টেলিভিশন চলে না সেই গ্রামে ইন্টারনেট চলে। টেলিভিশনের চেয়ে যে ইন্টারনেট নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য আরও ভয়ঙ্কর তা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। এমন কন্ট্রাডিকশন নিয়ে ছবির গল্প। ছবির প্রথমার্ধে প্রচুর হিউমার। আর এই হিউমারের কারণে প্রথমার্ধে গল্পের চেয়ে আনন্দই বেশী দেয়া বলে মনে হলো। মনে হলো এতই যদি হিউমার আনতে হয় তাহলে কেবল সংলাপ দিয়ে কেনো? নোয়াখালির একটা দ্বীপের মতো অঞ্চল বলেই কি ঐ দ্বীপের মানুষদের কথায় হিউমার বেশী থাকবে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো না। কারণ খুঁজে লাভ নেই। এই উত্তর ছবিতে নেই। এই প্রথম অর্ধের ভেতর সিনেমা দেখতে বসছি এই কথা একবারও মনে হয় নাই, কেবল মনে হৈতেছিলো যে সিনেমা দেখতে আসছি কিন্তু সিনেমাটা কখন শুরু হবে? সেই সিনেমা আর শুরু হয় নাই। মাঝে মাঝে ট্রেলার দেখাইয়া আবার তার নিজের স্থানে ফেরত গেছে। অভিনেতা অভিনেত্রীদের অধিকাংশেরই মুখে নোয়াখালি অঞ্চলের ভাষাটা কেমন যেনো মানানসই লাগছিলো না। মনে হচ্ছিলো তারা নোয়াখালীর ভাষাই বলতেছে তবে মুখস্থ করে। চেয়ারম্যান চরিত্রে শাহির হুদা রুমিকে নির্বাচন আমার মোটেও মনপুত হয় নি। এই গল্প কেনো নোয়াখালির হবে তাও ঠিক ততটা স্পষ্ট না। একটা কারণ হিসেবে দাঁড় করানো যায়, তা হলো ঐ দ্বীপ সাম্রাজ্যের প্রসঙ্গ। কিন্তু সেই প্রসঙ্গ ধূপে টেকে না কারণ, যে এই ক্ষমতাটা দেখাতে পারে সে সবখানেই পারে। যেই গল্পটি এই ছবিতে বলা হয়েছে, সুদূর গ্রামের গল্প যেখানে টেলিভিশন ও মোবাইল ফোনই রীতিমত আন-এভিইলেবল, সেই গল্প বলার জন্য আধুনিক ব্যান্ড শিল্পীদের মিউজিকে করা একেরপর এক গান অন্যদের কেমন লেগেছে তা আমার জানা নাই। ছবিতে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর খুঁজেই পাই নাই। ছবির সিনেমাটোগ্রাফি আরামদায়ক ছিলো। লাইট চমৎকার, কম্পোজিশনও বেশ ভালো। কিন্তু বারবার যে জিনিসটি মিস করতেছিলাম তা হৈলো ঐ সিনেমা সিনেমা ভাব। আজকে যখন অফিসে কথা হচ্ছিলো টেলিভিশন নিয়ে, তখন একজন বললো তার মেয়ে ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ সিনেমা দেখার পর নাকি বলছিলো টেলিফিল্ম দেখতেছে। আমি একটা জায়গা ভেবে প্রতিবাদ করি নি। কারণ, টিভির নির্মাতারা সিনেমা বানাতে গেলে তারা টিভির যে চর্চা, ঐ চর্চার মতো করেই সিনেমা বানাতে চায়। আর এ কারণেই সিনেমা দেখার পরও তা টিভি প্রোডাকশন বলে মনে হয়। এই ছবি দেখার পরও আমার তাই মনে হচ্ছিলো। আমি সেই মোস্তফা সরয়ার ফারুকী কেই দেখছি যিনি ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ ছবির পরিচালক। কিছুটা মুন্সিয়ানা এখানেও দেখিয়েছেন সেটা ঐ প্রত্যাশার পারদ যে উঁচুতে উঠছিলো তা মেটায় নাই। কিছু কিছু আশ্চর্য রকম চিত্রকল্প কিছু কিছু বিরক্তিকর দৃশ্যায়নের সাথে প্লাসে মাইনাসে ছবিটার অনেক ক্ষেত্রেই যোগফল রাখতে সাহস পায় না। তবে ছবির বেশ কিছু জায়গা চোখে লেগে থাকবে তার একটি হলো কুহিনূরের (তিশা) সাথে সোলাইমানের (চঞ্চল) ফোনে কথা বলার দৃশ্য। ফোনটি কোনও এক জায়গায় রেখে দাও, যেন আমি তোমার হাটা চলার শব্দ শুনতে পাই আর মনের ‘টেলিভিশন’ দিয়ে দেখতে পাই তোমারে। অসাধারণ সরয়ার ভাই। আপনি যে পারেন এই দৃশ্যে আপনি তা দেখিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আপনি বলুনতো, এই দৃশ্যটা যে সিনেমায় থাকে সেই সিনেমাটার অন্যসবকিছু এর আশ-পাশের মানেরও হয়েছে? আমি জানি না। এছাড়া ছবির শেষে যখন আমিন চেয়ারম্যান প্রতারিত হয়ে হোটেলে মাস কাটিয়ে হজ্জ্বের কথা বলে বাড়ি আসবে বলে চিন্তা করে। বা অপেক্ষা করে হজ্জ্ব করে তবেই বাড়ি যাবে, তার যে পরাজয় এই পরাজয় কি কাম্য? এই পরাজয় কি তাকে মাটিতে মিশিয়ে দেয় না? সেই পরাজয়ের গল্প তো তার গ্রামেই সবচেয়ে বেশী অনুভূতিপ্রবণ হতে পারতো। অন্তত আমার তাই মনে হয়। অথবা আমিন চেয়ারম্যানের যে হজ্জ্বের জন্য হাহাকার, তা যত দীর্ঘ সময় দেখানো হয়েছে, এতে করে কি হাহাকার খুব তীব্র বোঝা যায়? আমি বুঝি নি। ছবির অনেক ক্ষেত্রেই মনে হয়েছে আপনি ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ইচ্ছা করেই এড়িয়ে গেছেন। এই এড়িয়ে যাওয়াকে কি আপনার অন্য কোনও পরিকল্পনা কাজ করেছে? এই পরিকল্পনার কারণে কিন্তু অনেক ভালো ইমোশন ক্রিয়েট করার সুযোগ তৈরি হয়েও হয় নি। তা কি ভালো হলো? এত এত প্রশ্নের উত্তর আমি পাই নি। মনে হয় পাবোও না।
তারপরও ছবিটা হয়তো দেশের বাইরের আরও কিছু ফ্যাস্টিভ্যালে যাবে, কিছু পুরস্কারও পাবে। তবে এ প্রসঙ্গে কিছু না বললেই নয়। তা হলো আমাদের ছবি নিয়ে বড় বড় ফ্যাস্টিভ্যাল কমিটির যে দৃষ্টিভঙ্গিটা থাকে তা হলো, বাংলাদেশ একটা উন্নয়নশীল দেশ, এই দেশের উন্নয়নশীল ছবির জন্য আমরা না হয় একটু সহযোগীতা করলামই। এই দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি আমাদের গল্প ও নিজেদের বিক্রয় করবার যা থাকে তা হলো তাদের মনোযোগ আকর্ষণের ভাবনাগুলো। এই ছবিতে তা করা হয়েছে বলেই মনে হয়েছে আমার। যেই অভিযোগটা তারেক মাসুদকে নিয়েও কেউ কেউ করেছিলো। তার নামে অভিযোগ ছিলো, তারেক মাসুদ ইউরুপের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ছবি বানায়, এ কারণে সেই ছবি সেইসব ফ্যাস্টিভ্যালে প্রশংসিত হয়। এই অভিযোগ পুরুপুরি সত্য না হলেও কিছুটা তার সাথে যায়। যদিও তিনি তা অতিক্রম করেও দেখিয়েছেন। কিন্তু এই ছবিতেও তো একই ভাবনার প্রমাণ পাই। নয়তো ‘টেলিভিশন’ এর গল্প বলতে গিয়ে ধর্মীয় একটি চরিত্রই কেনো শিকার হবে তার?

সিনেমাহলের ‘টেলিভিশন’

at রবিবার, জানুয়ারী ২৭, ২০১৩  |  9 comments

বাংলাদেশের ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর একটা বেশ ভালো ভূমিকা আছে। এ কথা নিশ্চয়ই কেউ অস্বীকার করবে না। আমিও করি না। আমি বরং এক কাঠি সরেশ হয়ে তাকে একটা ‘বিপ্লবী’র স্থানে দেখতে চাই। আর সেই বিপ্লবটা সেই ক্ষেত্রে, যখন বাংলাদেশের দর্শকরা ইটিভি বাংলা ছাড়া আর হাতে গোনা কয়েকজন টিভি নাট্যনির্দেশকের নাটক ছাড়া আর কিছুই বুঝতো না, তখন তিনি নতুন জানালা খোলে দিয়েছিলেন। তার টিভি নাটক মানুষ এক সময়ের ‘অয়োময়’ ‘সংসপ্তক’ এর মতো নাটক যেভাবে দেখতো ঠিক সেভাবে হয়তো দেখতো না, কিন্তু তার নাটক মানুষ উৎসব সহকারে দেখতো। এখন তিনি আর নাটক বানান না, সিনেমা বানান। একজন নির্মাতার এইটাই চূড়ান্ত পরিচয় ও অবস্থানের স্থান। তার জন্যও তিনি সেলুট পাওয়ার দাবি রাখেন। সেইটুক আমি তাকে দিতে চাই এবং তা আমার মন থেকে তিনি অকুণ্ঠভাবেই পেয়ে থাকেন। তাঁর চতুর্থ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘টেলিভিশন’। এর আগে তিনি তিন তিনটি ছবি নির্মাণ করেছেন। দর্শক সমালোচকদের কাছে প্রশংসা ও সমালোচনা তিনি দুটোই পেয়েছেন। আমার ব্যক্তিগত অবজারভেশন বলে প্রশংসা পেলে তিনি আহ্লাদে গদগদ হয়ে যান না, খুশী হন (প্রশংসা কে না পছন্দ করে?)। আবার সমালোচনা পেলে তিনি সেটাও যে খুব বিরক্ত হন তা না, তার প্রতিবাদের ভাষা অন্য রকম হয়ে গিয়ে একটা সিনেমাও হয়ে যেতে পারে। যার প্রমাণ আমরা ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ এর প্রকাশিত ডিভিডিতে দেখেছি।
সে যাই হোক, সমালোচনাকে গ্রহণযোগ্যভাবে দেখতে না পারলে তাকে আমি ততটা গুরুত্ব দিতে রাজি না। যে কাজ করতে তার সমালোচনা হবেই। যদি সমালোচনা গ্রহণ করতে পারেন, তবেই উন্নতি হবে। নইলে যা আছে তাই থাকবে, বরং অবনতিও হতে পারে। এই কথাগুলো বলা এ কারণে যে, সরয়ার ফারুকির তৃতীয় ছবি যখন মুক্তি পায়, তখন প্রয়াত নির্মাতা তারেক মাসুদ বলেছিলেন, দান দান তিন দানে যেমন আমরা সেরাটা প্রত্যাশা করি, সরয়ার এর কাছেও তাই প্রত্যাশা করি। তবে সেই ছবি দেখার পর তারেক মাসুদের প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিলো তা আমার জানা নাই। তাই আমি ঠিক এটা বলতে পারছিনা তৃতীয় দানটা কি তিনি পুরনো দানগুলোর লাভ-ক্ষতি পুষিয়ে দিয়েছিলেন কিনা। এইখানে আমার সন্দেহ রয়েছে। কারণ সেই তৃতীয় দান অতিক্রম করে এখন চতুর্থ দান-এ গিয়ে পরেছেন তিনি। একজন চলচ্চিত্রকার যদি তার চতুর্থ ছবিতে এসেও আশ্চর্য রকম কিছু করতে না পারেন, তাহলে সাধারণত ধরে নিয়ে থাকি সেই চলচ্চিত্রকার আর আশ্চর্যরকম কিছু করতে পারবে না। এ কথা সব ক্ষেত্রেই কাজে দেয় বলে ধারণা করি। যদিও ব্যতিক্রম সব সময়ই হিসেবের বাইরে।
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। ‘টেলিভিশন’ ছবিটি প্রথম প্রিমিয়ার হয়েছে ‘পুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব-২০১২’ তে। তবুও যেনতেন প্রিমিয়ার নয়, ক্লোজিং ফিল্ম হিসেবে তা প্রিমিয়ার হয়েছে। এই ছবি দেখে আমারও (অন্য অনেকের মতো- সেই দলে এই ছবির নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকিও রয়েছেন) প্রিয় নির্মাতা কিম কি দুক বলেছেন, গুড ফিল্ম। পরবর্তিতে দুবাই আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফ্যাস্টিভ্যালে এ ছবি ‘বিশেষ পুরস্কার’ পেয়েছে। এসব কারণে ‘টেলিভিশন’ ছবি নিয়ে আগ্রহ ছিলো। সেই আগ্রহ মেটাতে শুক্রবার বিকেলেই ছবিটি দেখার মনস্থির করেছিলাম। নানান কারণে তা হলো না। শনিবার সন্ধ্যার টিকিট করে সারারাত সারাদিন এর অপেক্ষায় ছিলাম। সিনেমা শুরুর সময় সিনেমার টাইটেল প্রেজেন্টেশন ভালো লেগেছে। ছবির রিভিউ পড়ার সুবাদে গল্পটি জেনে গিয়েছিলাম আগেই। যা জেনেছি তাতে মনে হৈছে এই ছবির বাংলাদেশী কোনও প্রিমিয়ার হৈলে ছবিটা দর্শকদের কাছ থেকে গ্রহণযোগ্যতা এখন যতটুকু পাচ্ছে তার চেয়ে হয়তো একটু কম পেতো। ছবির গল্প মোটামোটি এই- একজন ধর্মান্ধ চেয়ারম্যান (ধর্মভিরু বলবো না এই কারণে যে, ধর্ম ভিরুরা কখনোই ধর্ম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে না, কেবল নিজে বাঁচার জন্য ধর্মের আশ্রয় নেয়। অপরদিকে ধর্মান্ধরা ধর্মকে ঢাল করে চারপাশে ধর্মের লৌকিক জগত তৈরি করতে চায়। এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র আমার ধারণা তাই করেছে। এ কারণেই তিনি ধর্মান্ধ) নিজের গ্রামে টেলিভিশন নিষিদ্ধ করেছে। তার ধারণা টেলিভিশন দেখলেই মানুষ নষ্ট হয়ে যাবে। এই টেলিভিশনের কাছেই তাকে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হইতে হয়। মাঝখানে আছে প্রেম, সংগ্রাম, আর কিছুটা ড্রামা। এইসব বিস্তারিত বলার তেমন ইচ্ছাই হইতেছে না। ছবিটা নিয়া যে লিখতে বসছি তার কারণ অন্য। তার কারণ হৈলো এই ছবিটার প্রত্যাশার পারদ এত বেশী উড়ছিলো যে, তেমনি কইরা পারদ গইল্যা কুয়াশা হৈয়া গেছে। ছবির গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ঐ চেয়ারম্যান এতই ধর্মান্ধ যে পাসপোর্ট করতে ছবি তুলতে হবে বলে সে হজ্জ্ব করতে যেতে চায় না। কিন্তু এই ছবির দুই গল্পকার ভুলে যায় চেয়াম্যান নির্বাচন করতে হলে যে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে হয় তাতে প্রার্থীর ছবি দিতেই হবে। না দিলে মনোনয়ন বাতিল। যে গ্রামে টেলিভিশন চলে না সেই গ্রামে ইন্টারনেট চলে। টেলিভিশনের চেয়ে যে ইন্টারনেট নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য আরও ভয়ঙ্কর তা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। এমন কন্ট্রাডিকশন নিয়ে ছবির গল্প। ছবির প্রথমার্ধে প্রচুর হিউমার। আর এই হিউমারের কারণে প্রথমার্ধে গল্পের চেয়ে আনন্দই বেশী দেয়া বলে মনে হলো। মনে হলো এতই যদি হিউমার আনতে হয় তাহলে কেবল সংলাপ দিয়ে কেনো? নোয়াখালির একটা দ্বীপের মতো অঞ্চল বলেই কি ঐ দ্বীপের মানুষদের কথায় হিউমার বেশী থাকবে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো না। কারণ খুঁজে লাভ নেই। এই উত্তর ছবিতে নেই। এই প্রথম অর্ধের ভেতর সিনেমা দেখতে বসছি এই কথা একবারও মনে হয় নাই, কেবল মনে হৈতেছিলো যে সিনেমা দেখতে আসছি কিন্তু সিনেমাটা কখন শুরু হবে? সেই সিনেমা আর শুরু হয় নাই। মাঝে মাঝে ট্রেলার দেখাইয়া আবার তার নিজের স্থানে ফেরত গেছে। অভিনেতা অভিনেত্রীদের অধিকাংশেরই মুখে নোয়াখালি অঞ্চলের ভাষাটা কেমন যেনো মানানসই লাগছিলো না। মনে হচ্ছিলো তারা নোয়াখালীর ভাষাই বলতেছে তবে মুখস্থ করে। চেয়ারম্যান চরিত্রে শাহির হুদা রুমিকে নির্বাচন আমার মোটেও মনপুত হয় নি। এই গল্প কেনো নোয়াখালির হবে তাও ঠিক ততটা স্পষ্ট না। একটা কারণ হিসেবে দাঁড় করানো যায়, তা হলো ঐ দ্বীপ সাম্রাজ্যের প্রসঙ্গ। কিন্তু সেই প্রসঙ্গ ধূপে টেকে না কারণ, যে এই ক্ষমতাটা দেখাতে পারে সে সবখানেই পারে। যেই গল্পটি এই ছবিতে বলা হয়েছে, সুদূর গ্রামের গল্প যেখানে টেলিভিশন ও মোবাইল ফোনই রীতিমত আন-এভিইলেবল, সেই গল্প বলার জন্য আধুনিক ব্যান্ড শিল্পীদের মিউজিকে করা একেরপর এক গান অন্যদের কেমন লেগেছে তা আমার জানা নাই। ছবিতে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর খুঁজেই পাই নাই। ছবির সিনেমাটোগ্রাফি আরামদায়ক ছিলো। লাইট চমৎকার, কম্পোজিশনও বেশ ভালো। কিন্তু বারবার যে জিনিসটি মিস করতেছিলাম তা হৈলো ঐ সিনেমা সিনেমা ভাব। আজকে যখন অফিসে কথা হচ্ছিলো টেলিভিশন নিয়ে, তখন একজন বললো তার মেয়ে ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ সিনেমা দেখার পর নাকি বলছিলো টেলিফিল্ম দেখতেছে। আমি একটা জায়গা ভেবে প্রতিবাদ করি নি। কারণ, টিভির নির্মাতারা সিনেমা বানাতে গেলে তারা টিভির যে চর্চা, ঐ চর্চার মতো করেই সিনেমা বানাতে চায়। আর এ কারণেই সিনেমা দেখার পরও তা টিভি প্রোডাকশন বলে মনে হয়। এই ছবি দেখার পরও আমার তাই মনে হচ্ছিলো। আমি সেই মোস্তফা সরয়ার ফারুকী কেই দেখছি যিনি ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ ছবির পরিচালক। কিছুটা মুন্সিয়ানা এখানেও দেখিয়েছেন সেটা ঐ প্রত্যাশার পারদ যে উঁচুতে উঠছিলো তা মেটায় নাই। কিছু কিছু আশ্চর্য রকম চিত্রকল্প কিছু কিছু বিরক্তিকর দৃশ্যায়নের সাথে প্লাসে মাইনাসে ছবিটার অনেক ক্ষেত্রেই যোগফল রাখতে সাহস পায় না। তবে ছবির বেশ কিছু জায়গা চোখে লেগে থাকবে তার একটি হলো কুহিনূরের (তিশা) সাথে সোলাইমানের (চঞ্চল) ফোনে কথা বলার দৃশ্য। ফোনটি কোনও এক জায়গায় রেখে দাও, যেন আমি তোমার হাটা চলার শব্দ শুনতে পাই আর মনের ‘টেলিভিশন’ দিয়ে দেখতে পাই তোমারে। অসাধারণ সরয়ার ভাই। আপনি যে পারেন এই দৃশ্যে আপনি তা দেখিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আপনি বলুনতো, এই দৃশ্যটা যে সিনেমায় থাকে সেই সিনেমাটার অন্যসবকিছু এর আশ-পাশের মানেরও হয়েছে? আমি জানি না। এছাড়া ছবির শেষে যখন আমিন চেয়ারম্যান প্রতারিত হয়ে হোটেলে মাস কাটিয়ে হজ্জ্বের কথা বলে বাড়ি আসবে বলে চিন্তা করে। বা অপেক্ষা করে হজ্জ্ব করে তবেই বাড়ি যাবে, তার যে পরাজয় এই পরাজয় কি কাম্য? এই পরাজয় কি তাকে মাটিতে মিশিয়ে দেয় না? সেই পরাজয়ের গল্প তো তার গ্রামেই সবচেয়ে বেশী অনুভূতিপ্রবণ হতে পারতো। অন্তত আমার তাই মনে হয়। অথবা আমিন চেয়ারম্যানের যে হজ্জ্বের জন্য হাহাকার, তা যত দীর্ঘ সময় দেখানো হয়েছে, এতে করে কি হাহাকার খুব তীব্র বোঝা যায়? আমি বুঝি নি। ছবির অনেক ক্ষেত্রেই মনে হয়েছে আপনি ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ইচ্ছা করেই এড়িয়ে গেছেন। এই এড়িয়ে যাওয়াকে কি আপনার অন্য কোনও পরিকল্পনা কাজ করেছে? এই পরিকল্পনার কারণে কিন্তু অনেক ভালো ইমোশন ক্রিয়েট করার সুযোগ তৈরি হয়েও হয় নি। তা কি ভালো হলো? এত এত প্রশ্নের উত্তর আমি পাই নি। মনে হয় পাবোও না।
তারপরও ছবিটা হয়তো দেশের বাইরের আরও কিছু ফ্যাস্টিভ্যালে যাবে, কিছু পুরস্কারও পাবে। তবে এ প্রসঙ্গে কিছু না বললেই নয়। তা হলো আমাদের ছবি নিয়ে বড় বড় ফ্যাস্টিভ্যাল কমিটির যে দৃষ্টিভঙ্গিটা থাকে তা হলো, বাংলাদেশ একটা উন্নয়নশীল দেশ, এই দেশের উন্নয়নশীল ছবির জন্য আমরা না হয় একটু সহযোগীতা করলামই। এই দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি আমাদের গল্প ও নিজেদের বিক্রয় করবার যা থাকে তা হলো তাদের মনোযোগ আকর্ষণের ভাবনাগুলো। এই ছবিতে তা করা হয়েছে বলেই মনে হয়েছে আমার। যেই অভিযোগটা তারেক মাসুদকে নিয়েও কেউ কেউ করেছিলো। তার নামে অভিযোগ ছিলো, তারেক মাসুদ ইউরুপের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ছবি বানায়, এ কারণে সেই ছবি সেইসব ফ্যাস্টিভ্যালে প্রশংসিত হয়। এই অভিযোগ পুরুপুরি সত্য না হলেও কিছুটা তার সাথে যায়। যদিও তিনি তা অতিক্রম করেও দেখিয়েছেন। কিন্তু এই ছবিতেও তো একই ভাবনার প্রমাণ পাই। নয়তো ‘টেলিভিশন’ এর গল্প বলতে গিয়ে ধর্মীয় একটি চরিত্রই কেনো শিকার হবে তার?

Read More

9 মন্তব্য(গুলি):

বুধবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৩

তাইওয়ানের ডিরেক্টর অং-কার ওয়াই এর একটা ছবি দেখতে বসেছিলাম। ছবিটার নাম হ্যাপি টুগেদার। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া এ ছবি বিশ্বের বেশ কয়েকটি বড় বড় চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পেয়েছে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচকদের কাছ থেকে পেয়ে অনেক প্রশংসাসূচক বাক্য। ছবিটার গল্পের মুল বিষয় হলও প্রেম। কিন্তু এই প্রেম রোমিও-জুলিয়েট, শিরি-ফরহাদ বা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের মতো তো নয়ই বরং বলা যায়, স্বাভাবিক জীবনের একটি ছেলের সাথে একটি মেয়ের প্রেমের গল্প নয়। গল্পটি একটি ছেলের সাথে একটি ছেলের প্রেমের। আর এই প্রেমের পাশাপাশি এখানে যৌন জীবনও এসে হাজির। একটি ছেলের সাথে একটি ছেলের যখন যৌন জীবনের সম্পর্ক তৈরি হয়, তখন সেটাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বা সমাজ জীবনের চোখে স্বাভাবিক যৌন জীবন হিসেবে উল্লেখ করা হয় না। তখন এই অবস্থাটাকে চিহ্নায়ন করার জন্য পৃথক শব্দ ব্যবহার করা হয়, আর তা হলও ‘সমকাম’। এই সমকাম শুধু ছেলেদের মাঝেই নয়, মেয়েদের মাঝেও রয়েছে। আর এই বিষয়ক একটি জীবনের গল্প নিয়ে আমি প্রথম যে ছবিটি দেখি তা দীপা মেহতার ‘ফায়ার’। এ ছবিতে দুই জন বিবাহিত নারী এই রকম একটি যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আর সেই চরিত্র দুটো রূপায়ন করেছিলো শাবানা আজমি ও নন্দিতা দাশ। পর্দায় সম-লিঙ্গের যৌন সম্পর্কের ছবি দেখার সেই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। পরবর্তীতে আমি অনেক ছবি দেখেছি যার মাঝে সম-লিঙ্গের সম্পর্কের গল্প রয়েছে। সেইসব ছবির মাঝে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলও ‘ব্রোকব্যাক মাউন্টেন’, ‘রোম ইন দ্যা রুম’, ‘দ্যা বোং কানেকশনসহ অনেক। এইসব ছবির পাশে একটা ছেলের সাথে আর একটা ছেলের যৌন সম্পর্কের গল্প আমি দেখেছি ভারতীয় ছবি ‘আই এম’ এ। তবে সেখানকার প্রেক্ষাপটটা আরও ভিন্ন। সেখানে একজন পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ তার স্ত্রীর প্রথম পক্ষের ছেলে শিশুটিকে যৌন নির্যাতন করতো। এই নির্যাতনটা মূলত ঐ শিশুটির জীবনের ভবিষ্যৎ ভাবনায় এক বড় প্রভাব ফেলে পরবর্তীতে। সে মেয়েদেরও এড়িয়ে চলতে চায়। চায় কুৎসিত যৌন জীবনকে অতিক্রম করে একটা নিজের মতো জীবন গড়তে। যদিও সেটা স্বাভাবিক জীবন নয়, কিন্তু সেও এক সময় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। ফিরে আসলেও তার শৈশবের সেইসব নির্যাতনের স্মৃতি তাকে সব সময়ই তাড়িয়ে বেড়ায়। এই সেক্স এবিউজের যে অভিজ্ঞতা এই বিষয়টি নিয়ে আমার দেখা ছবির ভেতর ছবির ভাগ নেই বললেই চলে। স-বেধন নীলমণি ঐ ‘আই এম’। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে আমার ভাবনা রয়েছে। আমি মনে করি আমাদের সমাজে শিশু ও শৈশবের এমন যৌন নির্যাতনের ফলে নির্যাতিতার মস্তিষ্কে এক ধরণের চাপ তৈরি হয়। আর এই চাপের ফলে সেই শিশুটি যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হয় তখনো তার ভেতর এই স্বাভাবিক জীবনের অংশ হিসেবে যৌন জীবন নিয়ে এক ধরণের কমপ্লেক্স কাজ করে। যার ফলে সে মানসিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীনও হতে পারে। আবার উল্টো ফলও দেখা দিতে পারে ঐ প্রাপ্ত বয়স্ক যুবকটির মনে। সে হয়ে উঠতে পারে বিকৃত যৌন মানসিকতার ধারক। আর এর প্রভাব পড়বে সমাজে। সাম্প্রতিক কালে একের পর এক বিশ্রী যৌন অত্যাচারের খবরগুলোও এমনই কোনও বিকৃত যৌন চেতনার ধারকের ফলে হয়ে থাকতে পারে। এর পেছনের কারণ হিসেবে আমি ধারণা করতে পারি শৈশবের যৌন নির্যাতনের শিকারকে। আর এই একটা ছেলের (পূর্ণ বয়স্ক যুবকের) কাছে একটা শিশুর যৌন নির্যাতনের ঘটনা যে আমাদের সমাজেও ঘটছে বা ঘটে আসছে এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত সমাজকর্মী বা শিল্পের কোনও শাখাতেই তার প্রকাশ দেখি নি। আমাদের চলচ্চিত্রে তো নয়ই। অথচ তা আসাটাও কিন্তু জরুরী। একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা করা যেতে পারে এই নির্যাতনটি কি পরিমাণ ভয়ঙ্কর ও জঘন্য।
বছর দেড়েক আগে আমি তখন দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় কাজ করি। মরে যাওয়া পত্রিকাটি তখন নতুন যৌবনের উদ্যম নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছিলো। তখন একদিন হঠাৎ নিউজ ডেস্কে আমার হাতে একটি খবর সম্পাদনের জন্য আসে। খবরটি পরে আমি অনেকটা অবাক হই। খবরটি একটি খুনের ঘটনার। উত্তরায় এক কিশোর কর্তৃক এক মোবাইল ফোন রি-চার্জ ব্যবসায়ী খুন হন। পুলিশ ঐ কিশোর ছেলেটিকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ছেলেটি তার দোষ স্বীকার করে। খুন হওয়া ব্যক্তিটি একজন মোল্লা টাইপের মানুষ ছিলও। নামাজ পড়তো। মুখ ভর্তি দাড়ি ছিলও। এই লোকটিকে একটা কিশোর ছেলে কেনও খুন করতে পারে বলে মনে হয়? ছেলেটি তার দোকানে কর্মচারীর কাজ করতো। তবে কি ছেলেটিকে লোকটি নির্যাতন করতো? পরিশ্রম বেশী করাতো আর পারিশ্রমিক কম দিতো? এইসব ক্ষেত্রে আমাদের দেশে মানুষ এখনো ততটা হিংস্র হয়ে প্রতিবাদ করে থাকে না। এই খুনের ঘটনার পেছনে যেই নির্যাতনের ঘটনাটি পাওয়া যায় তখন তা হলও ঐ মোল্লা টাইপের লোকটি ঐ ছেলেটিকে যৌন নির্যাতন করতো। এবং ঘটনা এক সময় যখন তার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে, তখন ছেলেটি তাকে রাগ বা ঝোঁকের মাথায় খুন করে ফেলে। আমি যখন খবরটি সম্পাদনা করে বার্তা প্রধানের ডেস্কে দিয়ে দেই তিনি তখন এই সংবাদটিকে এক কলামের একটি স্থান বরাদ্দ করতে বলে। আমি তখন প্রতিবাদ করে বলি, এই ধরনের যৌন নির্যাতন দেশে হর হামেশাই হচ্ছে কিন্তু নানান কারণে খবরে আসছে না। কি পরিমাণ জঘন্য অত্যাচারের মুখোমুখি হলে একটা ছেলে একটা মানুষকে খুন করতে পারে এই ঘটনা তার প্রমাণ দেয়। তাই এটা বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। আমার কথায় সেদিন ঐ খবরটি শেষের পাতায় বক্স আইটেম করে প্রকাশিত হয়েছিলো। এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমিও হয়েছি। তখন আমি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি, আমাদের পাড়ায় আমার সম বয়সী এক বন্ধু তার প্রতিবেশী এক সাহেব কাছে ডাকলে না যাওয়ায় আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কেন তার কাছে সে যেতে চায় না। সে বলতে চাইতো না। আমি জোর করায় সে হাতের আঙুল দিয়ে এমন কিছু বিশ্রী ইঙ্গিত করেছিলো যে, তাতে আমার বুঝতে বাকি ছিলও না ঐ লোকটির কোনও এক সময়কার লালসার শিকার হয়েছিলো আমার বন্ধুটি। সাম্প্রতিক সময়েও আমি আমার চারপাশের বেশ কিছু বন্ধুদের সাথে কথা বলে জেনেছি, তাদের মাঝেও কেউ কেউ শৈশবে এমন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় এই নির্যাতনের পদ্ধতিটি একটি ধারাবাহিক ব্যাধির মতো আমরা আমাদের সমাজে বহন করে চলেছি। কিন্তু রোগটি যে আছে সে বিষয়েই সচেতন নই। ডাক্তার দেখাবো কি করে? আমি আমার সেই বন্ধুর অভিজ্ঞতাটার কথা স্মরণ করেছিলাম সম্প্রতি। হিসেব করে দেখলাম, প্রায় কুড়ি বছর আগের ঘটনা। এখনো গা ঘিন ঘিন করে, আমাদের সমাজ এতই কুণ্ঠিত এক বসতি যে আমরা আমাদের গ্লানিকর ঘটনাগুলো পর্যন্ত বলতে সাহস পাই না। কিন্তু এ খাঁচা যে ভাঙতেই হবে। না ভাঙলে এ থেকে যে মুক্তি নেই তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তাই যে ছবিটা আমি প্রথমেই বানাতে চাই, সেই ছবিটা আমি শুধু সেইসব শিশু-তরুণ-যুবকদের গল্প নিয়েই বানাতে চাই। যাতে আমাদের চারপাশের জীবনটাই তার মুখ দেখাবে।

আমি যে ছবিটি বানাতে চাই

at বুধবার, জানুয়ারী ২৩, ২০১৩  |  No comments

তাইওয়ানের ডিরেক্টর অং-কার ওয়াই এর একটা ছবি দেখতে বসেছিলাম। ছবিটার নাম হ্যাপি টুগেদার। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া এ ছবি বিশ্বের বেশ কয়েকটি বড় বড় চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পেয়েছে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচকদের কাছ থেকে পেয়ে অনেক প্রশংসাসূচক বাক্য। ছবিটার গল্পের মুল বিষয় হলও প্রেম। কিন্তু এই প্রেম রোমিও-জুলিয়েট, শিরি-ফরহাদ বা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের মতো তো নয়ই বরং বলা যায়, স্বাভাবিক জীবনের একটি ছেলের সাথে একটি মেয়ের প্রেমের গল্প নয়। গল্পটি একটি ছেলের সাথে একটি ছেলের প্রেমের। আর এই প্রেমের পাশাপাশি এখানে যৌন জীবনও এসে হাজির। একটি ছেলের সাথে একটি ছেলের যখন যৌন জীবনের সম্পর্ক তৈরি হয়, তখন সেটাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বা সমাজ জীবনের চোখে স্বাভাবিক যৌন জীবন হিসেবে উল্লেখ করা হয় না। তখন এই অবস্থাটাকে চিহ্নায়ন করার জন্য পৃথক শব্দ ব্যবহার করা হয়, আর তা হলও ‘সমকাম’। এই সমকাম শুধু ছেলেদের মাঝেই নয়, মেয়েদের মাঝেও রয়েছে। আর এই বিষয়ক একটি জীবনের গল্প নিয়ে আমি প্রথম যে ছবিটি দেখি তা দীপা মেহতার ‘ফায়ার’। এ ছবিতে দুই জন বিবাহিত নারী এই রকম একটি যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আর সেই চরিত্র দুটো রূপায়ন করেছিলো শাবানা আজমি ও নন্দিতা দাশ। পর্দায় সম-লিঙ্গের যৌন সম্পর্কের ছবি দেখার সেই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। পরবর্তীতে আমি অনেক ছবি দেখেছি যার মাঝে সম-লিঙ্গের সম্পর্কের গল্প রয়েছে। সেইসব ছবির মাঝে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলও ‘ব্রোকব্যাক মাউন্টেন’, ‘রোম ইন দ্যা রুম’, ‘দ্যা বোং কানেকশনসহ অনেক। এইসব ছবির পাশে একটা ছেলের সাথে আর একটা ছেলের যৌন সম্পর্কের গল্প আমি দেখেছি ভারতীয় ছবি ‘আই এম’ এ। তবে সেখানকার প্রেক্ষাপটটা আরও ভিন্ন। সেখানে একজন পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ তার স্ত্রীর প্রথম পক্ষের ছেলে শিশুটিকে যৌন নির্যাতন করতো। এই নির্যাতনটা মূলত ঐ শিশুটির জীবনের ভবিষ্যৎ ভাবনায় এক বড় প্রভাব ফেলে পরবর্তীতে। সে মেয়েদেরও এড়িয়ে চলতে চায়। চায় কুৎসিত যৌন জীবনকে অতিক্রম করে একটা নিজের মতো জীবন গড়তে। যদিও সেটা স্বাভাবিক জীবন নয়, কিন্তু সেও এক সময় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। ফিরে আসলেও তার শৈশবের সেইসব নির্যাতনের স্মৃতি তাকে সব সময়ই তাড়িয়ে বেড়ায়। এই সেক্স এবিউজের যে অভিজ্ঞতা এই বিষয়টি নিয়ে আমার দেখা ছবির ভেতর ছবির ভাগ নেই বললেই চলে। স-বেধন নীলমণি ঐ ‘আই এম’। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে আমার ভাবনা রয়েছে। আমি মনে করি আমাদের সমাজে শিশু ও শৈশবের এমন যৌন নির্যাতনের ফলে নির্যাতিতার মস্তিষ্কে এক ধরণের চাপ তৈরি হয়। আর এই চাপের ফলে সেই শিশুটি যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হয় তখনো তার ভেতর এই স্বাভাবিক জীবনের অংশ হিসেবে যৌন জীবন নিয়ে এক ধরণের কমপ্লেক্স কাজ করে। যার ফলে সে মানসিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীনও হতে পারে। আবার উল্টো ফলও দেখা দিতে পারে ঐ প্রাপ্ত বয়স্ক যুবকটির মনে। সে হয়ে উঠতে পারে বিকৃত যৌন মানসিকতার ধারক। আর এর প্রভাব পড়বে সমাজে। সাম্প্রতিক কালে একের পর এক বিশ্রী যৌন অত্যাচারের খবরগুলোও এমনই কোনও বিকৃত যৌন চেতনার ধারকের ফলে হয়ে থাকতে পারে। এর পেছনের কারণ হিসেবে আমি ধারণা করতে পারি শৈশবের যৌন নির্যাতনের শিকারকে। আর এই একটা ছেলের (পূর্ণ বয়স্ক যুবকের) কাছে একটা শিশুর যৌন নির্যাতনের ঘটনা যে আমাদের সমাজেও ঘটছে বা ঘটে আসছে এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত সমাজকর্মী বা শিল্পের কোনও শাখাতেই তার প্রকাশ দেখি নি। আমাদের চলচ্চিত্রে তো নয়ই। অথচ তা আসাটাও কিন্তু জরুরী। একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা করা যেতে পারে এই নির্যাতনটি কি পরিমাণ ভয়ঙ্কর ও জঘন্য।
বছর দেড়েক আগে আমি তখন দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় কাজ করি। মরে যাওয়া পত্রিকাটি তখন নতুন যৌবনের উদ্যম নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছিলো। তখন একদিন হঠাৎ নিউজ ডেস্কে আমার হাতে একটি খবর সম্পাদনের জন্য আসে। খবরটি পরে আমি অনেকটা অবাক হই। খবরটি একটি খুনের ঘটনার। উত্তরায় এক কিশোর কর্তৃক এক মোবাইল ফোন রি-চার্জ ব্যবসায়ী খুন হন। পুলিশ ঐ কিশোর ছেলেটিকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ছেলেটি তার দোষ স্বীকার করে। খুন হওয়া ব্যক্তিটি একজন মোল্লা টাইপের মানুষ ছিলও। নামাজ পড়তো। মুখ ভর্তি দাড়ি ছিলও। এই লোকটিকে একটা কিশোর ছেলে কেনও খুন করতে পারে বলে মনে হয়? ছেলেটি তার দোকানে কর্মচারীর কাজ করতো। তবে কি ছেলেটিকে লোকটি নির্যাতন করতো? পরিশ্রম বেশী করাতো আর পারিশ্রমিক কম দিতো? এইসব ক্ষেত্রে আমাদের দেশে মানুষ এখনো ততটা হিংস্র হয়ে প্রতিবাদ করে থাকে না। এই খুনের ঘটনার পেছনে যেই নির্যাতনের ঘটনাটি পাওয়া যায় তখন তা হলও ঐ মোল্লা টাইপের লোকটি ঐ ছেলেটিকে যৌন নির্যাতন করতো। এবং ঘটনা এক সময় যখন তার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে, তখন ছেলেটি তাকে রাগ বা ঝোঁকের মাথায় খুন করে ফেলে। আমি যখন খবরটি সম্পাদনা করে বার্তা প্রধানের ডেস্কে দিয়ে দেই তিনি তখন এই সংবাদটিকে এক কলামের একটি স্থান বরাদ্দ করতে বলে। আমি তখন প্রতিবাদ করে বলি, এই ধরনের যৌন নির্যাতন দেশে হর হামেশাই হচ্ছে কিন্তু নানান কারণে খবরে আসছে না। কি পরিমাণ জঘন্য অত্যাচারের মুখোমুখি হলে একটা ছেলে একটা মানুষকে খুন করতে পারে এই ঘটনা তার প্রমাণ দেয়। তাই এটা বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। আমার কথায় সেদিন ঐ খবরটি শেষের পাতায় বক্স আইটেম করে প্রকাশিত হয়েছিলো। এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমিও হয়েছি। তখন আমি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি, আমাদের পাড়ায় আমার সম বয়সী এক বন্ধু তার প্রতিবেশী এক সাহেব কাছে ডাকলে না যাওয়ায় আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কেন তার কাছে সে যেতে চায় না। সে বলতে চাইতো না। আমি জোর করায় সে হাতের আঙুল দিয়ে এমন কিছু বিশ্রী ইঙ্গিত করেছিলো যে, তাতে আমার বুঝতে বাকি ছিলও না ঐ লোকটির কোনও এক সময়কার লালসার শিকার হয়েছিলো আমার বন্ধুটি। সাম্প্রতিক সময়েও আমি আমার চারপাশের বেশ কিছু বন্ধুদের সাথে কথা বলে জেনেছি, তাদের মাঝেও কেউ কেউ শৈশবে এমন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় এই নির্যাতনের পদ্ধতিটি একটি ধারাবাহিক ব্যাধির মতো আমরা আমাদের সমাজে বহন করে চলেছি। কিন্তু রোগটি যে আছে সে বিষয়েই সচেতন নই। ডাক্তার দেখাবো কি করে? আমি আমার সেই বন্ধুর অভিজ্ঞতাটার কথা স্মরণ করেছিলাম সম্প্রতি। হিসেব করে দেখলাম, প্রায় কুড়ি বছর আগের ঘটনা। এখনো গা ঘিন ঘিন করে, আমাদের সমাজ এতই কুণ্ঠিত এক বসতি যে আমরা আমাদের গ্লানিকর ঘটনাগুলো পর্যন্ত বলতে সাহস পাই না। কিন্তু এ খাঁচা যে ভাঙতেই হবে। না ভাঙলে এ থেকে যে মুক্তি নেই তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তাই যে ছবিটা আমি প্রথমেই বানাতে চাই, সেই ছবিটা আমি শুধু সেইসব শিশু-তরুণ-যুবকদের গল্প নিয়েই বানাতে চাই। যাতে আমাদের চারপাশের জীবনটাই তার মুখ দেখাবে।

Read More

0 মন্তব্য(গুলি):

রবিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৩

পাখি আমার বরাবরই ভালো লাগে। ছেলেবেলায় বাড়িতে পাখি পোষা হতো। পাখি আমার কাছে আত্মিয়-বন্ধুর মতো। যখন খুব ছোট ছিলাম বাসায় বসেই পড়াশোনা করতে হতো, স্কুলে যাওয়ার বয়স হয় নি তখন আমার বন্ধু ছিলো একটি টিয়া পাখি ও একটি ময়না পাখি। তবে তারা পৃথক সময়ে আমার বন্ধু হয়েছিলো। বনের পাখি পোষ মানে, মানুষের মন মানে না। এই বাক্য শিখেছিলাম তখনই, যখন আমাদের পোষ মানা পাখিগুলো মানুষ ধরে নিয়ে যেতো। সেই থেকে আমি একার বন্ধুকে হারিয়ে পাখি বন্ধুর নাম ভুলে যেতে চেয়ে ছিলাম। এইভাবেই দিন কাটে, বয়স বাড়ে, স্কুলে পড়ি। স্কুলের/ পাড়ার বন্ধুদের সময় ও সঙ্গ অতিক্রম করে চেষ্টা করি নিজেকে অতিক্রম করতে। কিন্তু পারি না। কোথায় যেনো একটা শূন্যতা। সেই শূন্যতার বাস এখনো রয়ে গেছে। কিন্তু আমার পাখি প্রেম কমে নি। বলতে পারি, ইনাম আল হকের মতো পাখি প্রেমিক আমি নই। আমার প্রেমটা গোপনে আরও গোপনে। আমি ভালোবাসি একজোড়া পাখি। একটা নই। আর এজন্য ভালোবাসি মানুষ। সেই পাখির মতো, পাখির গল্পের মতো। কিন্তু সেই জোড়া পাখির দেখা তো নেই চারপাশে।
হ্যা, সেই একজোড়া পাখির স্বপ্ন আমি দেখি। স্বপ্ন দেখি একজোড়া মুনিয়ার জনক আমি। যে মুনিয়াগুলো খাঁচায় নয় খোলা বাতাসেই বসবাস করে। উড়ে বেড়ায়। একদিন একজনকে বলেছিলাম, আমার একজোড়া মুনিয়ার জননী হবি? সে পাখিগুলোর জননী হতে রাজি ছিলো, কিন্তু পাখিগুলো তখন তার হয়ে যাবে, আমার কিছুই থাকবে না বলে শর্ত দিয়েছিলো। আমি সেই শর্তে তাঁকে পাখিগুলোর জননীর অধিকার দিতে পারি নি। তাই এখনো পাখিগুলো আমার হতে পারলো না, আমাদের হতে পারলো না। এই আক্ষেপ প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা আমার বারান্দাজুড়ে এসে হানা দেয়। বারান্দার যন্ত্রণায় আমি কাতর হই।
সেই পাখি... হ্যা, পাখিদের নিয়ে এবার খেলা। নাম এ্যাংরি বার্ডস। খেলাটির পেছনে পাখিগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানলাম, অস্তিত্বের সংকটটা সেখানে বড় তীব্র। নিজেদের বাঁচিয়ে শত্রুদের ধ্বংস করার লক্ষ্যে তারা প্রতিবার ঝাপিয়ে পড়ে। ভাবে, আমি ধ্বংস হয়ে যাই তাতে আপত্তি নেই। আমার মাধ্যমে যদি শত্রুও ধ্বংস হয় তবে হয়তো আমার ভাই-বন্ধুরা বেঁচে যাবে। এই নিজেকে বিসর্জনের সাহস আর মানসিকতার কারণে তোমার নাম “এ্যাংরি বার্ডস”।

‘এ্যাংরি বার্ডস’ কেমন আছো?
আজ তোমাকে যে কবিতাটা পাঠিয়েছি, এই কবিতাটা তোমাকে নিয়ে ভাবতে বসে লিখা। সত্যি বলছি, তোমাকে যখন মাঝে মাঝে টেক্সট পাঠাই। উত্তর পেলে মনে হয় এ আমার বহু পরিচিত এক বন্ধু। মনে হয় তার হাত ধরে বহুদিন আমি অচেনা রাস্তায় হেঁটে গেছি গন্তব্য না জেনেই। আর তাই মাঝে মাঝে তোমাকে বলতে ইচ্ছে করে গোপন সব পাপ ও ব্যার্থতার হিসেব। অথচ তোমার ব্যস্ততার পরিসীমা নেই। এ নিয়ে অভিযোগ নেই। যতটুকু অনুভূতি প্রকাশে তুমি প্রশ্রয় দিয়েছো এতটুকুও যে এখন বন্ধুরা দেয় না। তারা তো ‘দূরের মানুষ’ হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। নাকি আমিই সেই পাখি প্রেমিকটি আর নেই? ঠিক বলতে পারবো না। তবে একটি কথা আমি ঠিকই বলতে পারবো, তোমার প্রশ্রয় দক্ষিণের বারান্দা আর জোড়া মুনিয়ার জন্য হাকার করবে না।

‘এ্যাংরি বার্ড'কে চিঠি

at রবিবার, জানুয়ারী ১৩, ২০১৩  |  No comments

পাখি আমার বরাবরই ভালো লাগে। ছেলেবেলায় বাড়িতে পাখি পোষা হতো। পাখি আমার কাছে আত্মিয়-বন্ধুর মতো। যখন খুব ছোট ছিলাম বাসায় বসেই পড়াশোনা করতে হতো, স্কুলে যাওয়ার বয়স হয় নি তখন আমার বন্ধু ছিলো একটি টিয়া পাখি ও একটি ময়না পাখি। তবে তারা পৃথক সময়ে আমার বন্ধু হয়েছিলো। বনের পাখি পোষ মানে, মানুষের মন মানে না। এই বাক্য শিখেছিলাম তখনই, যখন আমাদের পোষ মানা পাখিগুলো মানুষ ধরে নিয়ে যেতো। সেই থেকে আমি একার বন্ধুকে হারিয়ে পাখি বন্ধুর নাম ভুলে যেতে চেয়ে ছিলাম। এইভাবেই দিন কাটে, বয়স বাড়ে, স্কুলে পড়ি। স্কুলের/ পাড়ার বন্ধুদের সময় ও সঙ্গ অতিক্রম করে চেষ্টা করি নিজেকে অতিক্রম করতে। কিন্তু পারি না। কোথায় যেনো একটা শূন্যতা। সেই শূন্যতার বাস এখনো রয়ে গেছে। কিন্তু আমার পাখি প্রেম কমে নি। বলতে পারি, ইনাম আল হকের মতো পাখি প্রেমিক আমি নই। আমার প্রেমটা গোপনে আরও গোপনে। আমি ভালোবাসি একজোড়া পাখি। একটা নই। আর এজন্য ভালোবাসি মানুষ। সেই পাখির মতো, পাখির গল্পের মতো। কিন্তু সেই জোড়া পাখির দেখা তো নেই চারপাশে।
হ্যা, সেই একজোড়া পাখির স্বপ্ন আমি দেখি। স্বপ্ন দেখি একজোড়া মুনিয়ার জনক আমি। যে মুনিয়াগুলো খাঁচায় নয় খোলা বাতাসেই বসবাস করে। উড়ে বেড়ায়। একদিন একজনকে বলেছিলাম, আমার একজোড়া মুনিয়ার জননী হবি? সে পাখিগুলোর জননী হতে রাজি ছিলো, কিন্তু পাখিগুলো তখন তার হয়ে যাবে, আমার কিছুই থাকবে না বলে শর্ত দিয়েছিলো। আমি সেই শর্তে তাঁকে পাখিগুলোর জননীর অধিকার দিতে পারি নি। তাই এখনো পাখিগুলো আমার হতে পারলো না, আমাদের হতে পারলো না। এই আক্ষেপ প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা আমার বারান্দাজুড়ে এসে হানা দেয়। বারান্দার যন্ত্রণায় আমি কাতর হই।
সেই পাখি... হ্যা, পাখিদের নিয়ে এবার খেলা। নাম এ্যাংরি বার্ডস। খেলাটির পেছনে পাখিগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানলাম, অস্তিত্বের সংকটটা সেখানে বড় তীব্র। নিজেদের বাঁচিয়ে শত্রুদের ধ্বংস করার লক্ষ্যে তারা প্রতিবার ঝাপিয়ে পড়ে। ভাবে, আমি ধ্বংস হয়ে যাই তাতে আপত্তি নেই। আমার মাধ্যমে যদি শত্রুও ধ্বংস হয় তবে হয়তো আমার ভাই-বন্ধুরা বেঁচে যাবে। এই নিজেকে বিসর্জনের সাহস আর মানসিকতার কারণে তোমার নাম “এ্যাংরি বার্ডস”।

‘এ্যাংরি বার্ডস’ কেমন আছো?
আজ তোমাকে যে কবিতাটা পাঠিয়েছি, এই কবিতাটা তোমাকে নিয়ে ভাবতে বসে লিখা। সত্যি বলছি, তোমাকে যখন মাঝে মাঝে টেক্সট পাঠাই। উত্তর পেলে মনে হয় এ আমার বহু পরিচিত এক বন্ধু। মনে হয় তার হাত ধরে বহুদিন আমি অচেনা রাস্তায় হেঁটে গেছি গন্তব্য না জেনেই। আর তাই মাঝে মাঝে তোমাকে বলতে ইচ্ছে করে গোপন সব পাপ ও ব্যার্থতার হিসেব। অথচ তোমার ব্যস্ততার পরিসীমা নেই। এ নিয়ে অভিযোগ নেই। যতটুকু অনুভূতি প্রকাশে তুমি প্রশ্রয় দিয়েছো এতটুকুও যে এখন বন্ধুরা দেয় না। তারা তো ‘দূরের মানুষ’ হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। নাকি আমিই সেই পাখি প্রেমিকটি আর নেই? ঠিক বলতে পারবো না। তবে একটি কথা আমি ঠিকই বলতে পারবো, তোমার প্রশ্রয় দক্ষিণের বারান্দা আর জোড়া মুনিয়ার জন্য হাকার করবে না।

Read More

0 মন্তব্য(গুলি):

এই সাইটের যে কোনও লেখা যে কেউ অনলাইনে ব্যবহার করতে পারবে। তবে লেখকের নাম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।

Blogger template Proudly Powered by Blogger. Arranged By: এতক্ষণে অরিন্দম