ভারত বর্ষের সিনেমার ইতিহাসে যে সকল মানুষের নাম আবশ্যিক
উপস্থিত হয় তার মাঝে ঋত্বিক কুমার ঘটক এর নাম আসবেই। নিজের জীবনকে তিনি কখনোই
নিজের বলে ভাবেন নি। ভেবেছেন মানুষের জীবন হিসেবে। তাই আদ্যোপান্ত একজন আপোষহীন
মানুষ হিসেবে দিনকে দিন বেড়ে ওঠেছেন, বাড়িয়েছেন তাঁর প্রতি শিল্পের দায়। এই দায় কি
একটা কথা বা একটা গল্প বা একটা সিনেমার দায়? না এই দায় সংস্কৃতির দায়। সংস্কৃতি এই
দায়কে পোষণ করে। তার নিরন্তর বয়ে চলার মাঝেই তা বয়ে চলে। নইলে দিনকে দিন মানুষের
বুকের ভেতর থেকে সংস্কৃতির প্রতি যে টান, যাকে আমরা ভালোবাসা বা প্রেম বলি তা হয়তো
থাকতো না। অথচ শিল্পের প্রতি ভালোবাসার চেয়ে ঋত্বিকের বেশি ছিলো দায়। সেই দায়
থাকার কারনেই সে বলতে পেরেছিলো, সিনেমা আমার কাছে মানুষের কাছে পৌঁছানোর একটা
মাধ্যম। যেদিন মানুষের কাছে পৌছুতে এর চেয়ে ভালো কোনও মাধ্যম চলে আসবে, সেদিন
সিনেমাকে লাথি মেরে আমি তার কাছে চলে যাবো। অথচ এই শিল্পই কিনা ঋত্বিক কে বিক্রি
করতে ছাড়ে না। কড়ায় গন্ডায় তোলে নেয় তার দাম আর সেই শিল্প যদি হয় সিনেমা
তবে তো বলতে হবে বাণিজ্যিকি করণের ষোলকলা পূর্ণ হইলো। এত কথা বলার কারণ, ঋত্বিকের জীবনের ৯৫ ভাগ তথ্য ও ঘটনা নিয়ে ঋত্বিকের
সিনেমার নামেই নতুন করে সিনেমা নির্মাণ হয়, তাও আবার ‘সব
চরিত্র কাল্পনিক’ ‘অনুপ্রেরণা মাত্র’ উল্লেখ করে। তখন
আর বলার কিছু থাকে না। থাকবে কি করে, বাজার অর্থনীতির নিয়মই যে তা।
তার দেশেরই একজন লেখক, যে কিনা ফিল্ম বানানোর
চেষ্টা-চরিত্র করেও হয়েছেন কথা সাহিত্যিক। সেই শাহযাদ ফেরদাউস তার এক উপন্যাসে
লিখেছিলেন মুক্ত বাজার অর্থনীতির চূড়ান্ত রূপ কাকে বলে। কিভাবে বাজার আমাদের গ্রাস
করে, ঢুকে যায় আমাদের অন্দরেরও অন্দরে। যেখানে কেবল একা আমি, সেখানেও ‘বাজার’
বিষয়টি চলে আসে। শাহযাদের উপন্যাসে আমরা দেখেছিলাম একজন তার জীবন থেকে বিক্রয় করার
মত আর কিছু না পেয়ে ‘অতীত’ বিক্রয় করে দেয় চড়া দামে। তারপর সে বুঝতে শুরু
করে সে আসলে তার বায়বীয় ‘অতীত’টা কি, আর এর প্রভাবটাই বা কোথায় গিয়ে পরে। যেমন
রাতে ছোট ছেলে এসে জিজ্ঞাসা করে, বাবা অতীত কি? ছেলেকে বুঝানোর জন্য সে বলে, সকালে
যে তোমার ক্ষুধা লেগেছিলো, তুমি খেয়েছিলে সেটা অতীত। তখন ছেলেটা বলে তুমি যে তোমার
মায়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে, সেটাও কি তাহলে অতীত? তুমি কি তা বিক্রি করে দিয়েছো?
সেই প্রশ্নের উত্তর তার আর কিছু বলার থাকে না। আর এভাবেই বুঝতে পারে সব কিছু পণ্য
হয়ে গেলে মানুষের অন্তঃসার শূন্যতার কোনও মূল্য থাকে না। কমলেশ্বর মুখার্জীর
পরিচালিত ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিটাও তেমনি
ঋত্বিক কুমার ঘটকের অন্তঃসার সব কিছু দিয়েই নির্মিত। আর তাই পরিচালক নতুন কোনও
গল্প এখানে বলতে পারে নি। বলেছে ঋত্বিকেরই জীবন ও গল্প। তাও আবার কাল্পনিক মোড়কে।
কি আছে ‘মেঘে ঢাকা তারা’য়? এই
ছবির গল্প নীলকণ্ঠ বাগচী নামের একজন সংস্কৃতি কর্মীর। যিনি সংস্কৃতিকে মনে করতেন
সমাজ বদলের হাতিয়ার। তাই শুরুতে গান, গান থেকে নাটক, নাটক থেকে সিনেমায় এসেছিলেন
তিনি। পার্টির সদস্যদের তিনি বলেছিলেন, মানুষের কাছে পৌছানোর জন্য সিনেমার চেয়ে
ভালো কোনও মাধ্যম তার কাছে এলে সে সিনেমাকে লাথি মেরে চলে যাবে। সেই মানুষটা এক
সময় পার্টির কাছেও হয়ে পড়েছিলেন ব্রাত্য। জীবন, সমাজ ও সংসারে এই মানুষটি সারা
জীবন তার কথা বলতে গিয়ে চারপাশের মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে মানুষের জন্যই হাহাকার
করেছেন। আর এই সিনেমার গল্পই ছিলো এই জীবন। যা কিনা ঋত্বিক ঘটকেরই পূর্ণ জীবনের
সংস্কৃতিকর্মী অংশটিই মূখ্য ছিলো। শিল্প শ্রমিক ঋত্বিকের এইসব জীবন নাটক কম বেশী
সবাই জানে। তবে কখনোই পর্দায় অন্যের দ্বারা রূপান্তরিত হবে আর তা প্রদর্শণের আগে
বলবে তা কাল্পনিক ও মিলে যাওয়া কাকতালীয় এটা বোধহয় এক ধরনের ভাড়ামি ছাড়া আর কিছু
নয়।
ঋত্বিকের জীবন নিয়ে সিনেমা হচ্ছে জেনে ভালোই লেগেছিলো।
ছবির ট্রেলার দেখে মুগ্ধও হয়েছিলাম। সেই মুগ্ধতা বাড়িয়ে দিয়েছিলো বিভিন্ন সূত্রে
পাওয়া ছবির রিভিউ। কিন্তু কোথাও দেখিনি ছবি সম্পর্কে এই গুরুতর অভিযোগ সম্পর্কে
মুখ খুলতে। এসবও এক প্রকার বোঝাপড়ার বিষয়। যেমন জেনে আসছি, কাক কাকের মাংস খায় না।
তেমনই এই ছবি সম্পর্কে বলেছেন সে দেশের মিডিয়া। যেই লোকটা এমনই দেশাল ছিলেন, যে
দেশি মদে বুদ হয়ে থাকা মানুষটাকে বন্ধুরা জোর করে এক পেগ ভদকা খাইয়ে দিতে চাইলেও
তাতে তার বিতৃষ্ণা হতো। সেই লোকটার জীবনটা মহৎ হয়ে উঠতে পারতো এই ছবির একটি মাত্র
মিথ্যা না থাকলে। আর তা হলো ঐ ‘এই ছবির সমস্ত চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক’
মন্তব্যে।
পরিচালক কমলেশ্বরের ইচ্ছার জগতে ঋত্বিক না হয় বিক্রি
হয়েই গেলো, তা তো আর রুখতে পারা গেলো না। তাই বলে ছবিটা কি এনজয় করেছি কি না সে
কথাও তো বলতেই হয়। হ্যা, ছবিটা বেশ হয়েছে মাইরি। এই ছবির প্রত্যেকটা অণুষঙ্গ যদি
ঋত্বিক না হতো তবে তা পূর্ণতা পেতো বলেই মনে করি। রঙিন ছবির দুনিয়ায়ও সাদাকালো
পর্দার ছবিতে দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফি তো লোভ লাগানোর মতোই। এর সাথে শাশ্বত’র
অভিনয়ও বেশ উপভোগ্য ছিলো। সম্ভবত এই ছবিতেই সবচে ভালো আর সবচে বেশী অভিনয় করার
সুযোগ পেলেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। এর আগে তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্র মানে নায়কের চরিত্রে
অভিনয় করেছেন বলে মনে পড়ছে না। কিন্তু শাশ্বত’র প্রসঙ্গ আসলেই মনে
হয় এই রকম মোটকু একটা মানুষ কি করে ঋত্বিক ঘটকের চরিত্রে নির্বাচিত হলেন? এর প্রশ্নের
উত্তর পেতে অবশ্য বেশী দেরি হয় না। কারণ, মঞ্চে আমরা যেসব অভিনয় পদ্ধতির কথা জেনেছিলাম
তার মাঝে একটি পদ্ধতি ব্রেটল ব্রেখট এর। ব্রেখট বলতেন মঞ্চের অভিনয় যেহেতু পুরোপুরি
বাস্তব নয়, তাই সেখানেও কিছু গল্পের সাথে অবাস্তব সম্পর্কযুক্ত বিষয় রাখতেই হবে। বিষয়টা
অনেকটা এরকম, যে চিড়িয়াখানার গল্প বলা হলেও সেখানে হয়তো একটা সোফা থাকবে। যাতে বিষয়টি
পুরোপুরি বাস্তবানুগ না হয়। এখানে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে পরিচালক এই পদ্ধতিই এপ্লাই
করেছেন বলে বোধ করি। তবে শাশ্বত অভিনয় ভালো করেছেন। তার তুলনায় অনন্যা চ্যাটার্জির
অভিনয় তেমন কোনও নজর কাড়ে নি। তবুও আমরা পুরো ১৫৫ মিনিট বসে ছিলাম পর্দার সামনে।
কারণ, ঐ ঋত্বিক। ঐ ঋত্বিকের জন্যই উঠার উপায় ছিলো না। তবে শেষ দৃশ্যে এসেও প্রশ্ন
থেকেই যায়। যেখানে একজন রিফিউজি মেয়ের সাথে মনের আনন্দে ঋত্বিক বেড়িয়ে পড়েছেন
অজানা গন্তব্যে। আর সেই ছবিটাই ধীরে ধীরে রঙিন হয়ে যাচ্ছে। ঋত্বিক কি আসলেই এই
রঙিন জীবনের দেখা পেয়েছিলেন? নাকি বরাবরই স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন একটা রঙিন সমাজের?
যেই সমাজ তাকে কখনোই চিনতে, মূল্যায়ন করতে পারে নি। বরং আশার বদলে হতাশাই উপহার
দিয়েছে। এত কিছুর পরও শ্রীমাণ ঋত্বিক কুমার ঘটক ভালোবেসে গেছেন মানুষকে। কারণ,
তিনি জানতেন সব সময়ের সব কিছুই এই মানুষগুলোর জন্যই। আর মানুষই সব। বাকি সব
মিথ্যা।
0 মন্তব্য(গুলি):