মানুষের জীবনে যদি কখনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে তবে আমরা তার মূল্যায়ন করি ‘সিনেমার মতো’ বলে। কারণ, সিনেমার গল্পটা স্বাভাবিক জীবনের গল্প হবেই না অধিকাংশ সময়ই আমাদের মাথায় তা ডিফল্ট হিসেবে সেট করা থাকে। সেই ডিফল্ট ভাবনার বাইরে গিয়ে আমরা তাই ভাবতেও চাই না। কারণ, আমরা চাই একটা নির্ঝঞ্ঝাট ও সমান্তরাল জীবন। যেখানে সিনেমার মতো কোনও ভিলেন থাকবে না, কাউকে নায়কোচিত হয়ে সেই ভিলেনের কাছ থেকে বড় কিছু ছিনিয়ে আনতে হবে না, সর্বোপরি একটা ছকে বাঁধা জীবনই প্রত্যাশা করি। যদিও এর বাইরেও মানুষ ভাবে, প্রত্যাশা করে, জীবন কাটাতে চায়। তবে তা শতকরা হিসেবে খুবই কম। সেইসব কম মানুষেরা পৃথিবীতে একটু ভিন্ন ভাবেই বাঁচে, জীবন যাপন করে। আর তাই তাদের জীবন সম্পর্কেও চারপাশের মানুষের থাকে প্রচণ্ড কৌতুহল। বাংলা চলচ্চিত্রের পথে তেমন একজন ভিন্ন জগতের মানুষ ছিলেন চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন। যে সকল চলচ্চিত্রকারদের হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্র বিশ্ব দরবারে পরিচিত হয়েছে, মৃণাল তাদের একজন। কেবল একজন বললে ভুল হবে বলতে হবে, বলতে হয় শীর্ষস্থানীয়। আর তাই চলচ্চিত্রমোদী তরুণ-যুবা সহ চলচ্চিত্রপ্রেমিদের তাঁর প্রতি আগ্রহ থাকবেই। কিভাবে বেড়ে ওঠেন, কিভাবে হয়ে উঠেন একজন অনুকরণীয় চলচ্চিত্রকার।
হয়তো সেইসব আগ্রহ বা তাঁর নিজের জীবনের এই আলোর অনালোকিত জীবনের গল্পটা বলার জন্যই তিনি একটি বই লিখেছেন। লিখেছেন তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের আত্মজীবনী ‘তৃতীয় ভূবন’।
মৃণাল সেনে ছবি যতটা আগে দেখেছি, তাঁর লেখা তার সিকিভাগও আগে পড়িনি। তবে জেনেছিলাম তার লেখার হাত বেশ, গদ্য ঝড়ঝড়ে। সেই লোভে পরেই কিনে ফেলা হয় প্রত্যাশার চেয়েও বেশী দামের বই। আর কেনার পর একদিন মাঝ রাতে তার সাবলিল গদ্য পড়া শুরু করি। খুব বেশী দূর যাওয়ার আগেই এক জায়গায় এসে প্রচণ্ড ধাক্কা খাই, মন বিষাদে ভরে যায়। ঘটনার দিন ৭ আগস্ট ১৯৪১। হ্যা, ঠিকই ধরেছেন, ঐ দিন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর মহাপ্রয়াণ দিবস। ঐদিন তার চোখের সামনের ঘটনা। এখনকার বয়োবৃদ্ধ মৃণাল তখন যুবক। রবীন্দ্রনাথের দাহস্থান নিমতলা শ্মশানের ঘটনা। সে লিখেছে, “গঙ্গার ধারে এই নিমতলা ঘাটটি ক’দিন ধরেই সরকারি নিরাপত্তার মধ্যে রয়েছে যাতে কবির দেহের সৎকার সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়। পুলিশের কর্ডন ঘাটের গেটের সামনে। বাধ্য হয়েই আমি দূরে দাঁড়ালাম। আমার মতো আরো অনেকে উপায় না-দেখে দাঁড়িয়ে রইলো একটু দূরে। একটু তফাতে। কিন্তু সেই পুলিশ কর্ডনের ভেতর একটি লম্বা সুদর্শন যুবককে দেখে আমি একটু অবাকই হলাম। কতই বা বয়স হবে পঁচিশ-ছাব্বিশ। সাদা একটা ধুতি তাঁর পরনে আর গায়ে একটা কুর্তা। বিধ্বস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কর্ডনের ভেতরে। সেই যুবকের দুটি হাতে ওপর সাদা কাপড়ে মোড়া একটি মৃত শিশু, যাকে শ্মশানে দাহ করতে এনেছে যুবকটি. নিশ্চয়ই সেই শিশুটির বাবা। কিন্তু এখানে এসে এই নিষ্ঠুর পারিপার্শ্বিক
অবস্থায় সে যুবকটি দ্বিধাগ্রস্ত। ও অন্য কোনও শ্মশানে গেলো না কেন! ভাবলাম আমি। যুবকটি একাই এসেছে মনে হলো। হয়তো কোনও ব্যাপার আছে যে, এই নিমতলা ঘাটেই তার শিশুটিকে দাহ করতে হবে। হয়তো মনের ভেতর কোনও ইচ্ছে, যুবকটির কোনো বিশেষ অভিমান কাজ করছে। হঠাৎ ভিড়ের ঢেউ। সবদিক দিয়ে। কাতারে কাতার মানুষ শ্মশানঘাট অতিক্রম করতে চলেছে। অসংখ্য মানুষ ছুটে আসছে শ্মশানের দিকে।
পুলিশের সবরকম রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা ভেঙেচুড়ে চুরমার হয়ে গেলো জনতার মিছিলে। চারদিকে বিশৃঙ্খলা। ভিড়ের চাপে মানুষের মৃত্যু। কোনওরকম বড় দুর্ঘটনা ঘটছে! কিন্তু মৃত ঐ শিশুটি! শিশুটি হারিয়ে গিয়েছে, ভিড়ের চাপে মৃত শিশুটি পদপিষ্ট হয়েছে! ঐ যুবকটি কি একমাত্র সন্তানের পিতা হয়তো, ‘হ্যাঁ’ হয়তো বা ‘না’।” এপর্যন্ত পড়ার পর আমার পড়া বিষন্নতায় থমকে ছিলো। আবার যখন শুরু করলাম, আর কোনও বিষন্ন দিনের গল্প মৃণাল করে নি। কেবল ভালো গল্পগুলোই বলেছিলেন। হয়তো আমার মতো অনুভূতিপ্রবণ পাঠকের কথাও তার মনে ছিলো। নয়তো তার বাকি জীবনের চলচ্চিত্রযাত্রায় কি কোনও বিষন্ন ঘটনা নেই? ছিলো না?
মৃণাল সেন এর বই ‘তৃতীয় ভূবন’ এর বাকি সময়টা সবটাই ছিলো তার সিনেমার জগতের কথা। তবে সেই সিনেমার গল্পগুলোও খুব বর্ণনাত্মক হয়ে আসে নি। এসেছে তাঁর সিনেমার ও একই সাথে সিনেমার সাথে তার নিজের বিশ্বযাত্রার কথা। যেখানেও প্রতি পৃষ্ঠায় তাঁর নানা সাফল্যের গল্পই তিনি করেছেন। অথচ এইসব সাফল্যের গল্প পড়তে পড়তে একটা সময় মনে হয়, চলচ্চিত্রকার মৃণালের জীবনে কি কোনও ব্যার্থতা নেই? তবে সেই ব্যার্থতা কোথায়? হয়তো সেই ব্যার্থতার কথা বলতে গিয়েই তিনি লিখেছেন, ‘আই অ্যাম গ্রোয়িং ইন এভরি ফিল্ম। সে কারণেই আমার পুরনো ছবি সম্পর্কে আমি বেশ ক্রিটিকাল। মাঝে মাঝে মনে হয় যদি পুরো ছবিটাই ড্রেস রিহার্সেল মনে করে আবার তুলতে পারতাম।’ এই ভাবনা ও বক্তব্য প্রমাণ করে সে তার নির্মিত ছবিগুলোর দুর্বল দিকগুলো আড়াল করে আরো ভালো তৈরি করতে চান। কিন্তু এর বাইরে তিনি তেমন কিছু বলেন নি। তাই মনে পড়ে হুমায়ূন আজাদের কথা। তিনি বলেছিলেন, বাঙালী আত্মজীবনী লিখতে পারে না। বাঙালীর আত্মজীবনী হয় আত্মপ্রশংসার মহাকাব্য’।
মৃণাল সেন হয়তো অনিচ্ছা সত্বেও এড়িয়ে গেছেন তার সিনেমাযাত্রার ভুল-ত্রুটি বা দুর্বলতা। কিন্তু সিনেমার ভূবন নিয়ে কথা বললে সে তথ্যও এই বইয়ে স্থান পাওয়ার দাবী করে বলেই মনে করি। যদিও ঐ ভুলের তথ্য বা গল্প ছাড়াও যথেষ্ঠ সুন্দর ও সাবলিল গদ্যের জন্যই পড়তে পড়তে মৃণাল সেন এর এক জীবনের সিনেমাযাত্রার সাক্ষী হয়ে থাকা যায়। তাই বা কম কি! জয় সিনেমা যাত্রা।
0 মন্তব্য(গুলি):