চারপাশের পরিবেশটা এমন যে সিনেমা দেখে
রিভিউ লেখার মতো ‘স্বস্তিদায়ক’
মুড আসলে নাই। তারপরও নানা কারণে লিখতে বসছি। শুরুতেই এই বিষয়গুলো স্পষ্ট করে বলি। বাংলাদেশের
সিনেমার ইতিহাসে এবারের ঈদ একটা টার্নিং পয়েন্ট হইতে পারে। সেই
টার্নিং পয়েন্টটা আমাদের নিয়মিত নির্মাতারা অনুভব করতে পারলে সিনেমা ইন্ড্রাস্ট্রির
লাভ, নিজেদেরও
লাভ। এইটাই ছবির রিভিউ লিখতে বসার প্রধান কারণ। আর আর
কারণগুলো মূখ্য নয়, গৌন। তাই
সেগুলো অনুল্লেখ্যই থাকলো।
‘শিকারি’
ছবি দেখতে আমার বিশেষ কোনও আগ্রহ ছিলো না। আর দশটা
বাংলাদেশী বাণিজ্যিক ছবির মতোই আগ্রহ। তবে একটা বিষয় খুব চোখে পড়েছে,
এই ছবির নায়ক সাকিব খান কে নিয়ে আমাদের অনলাইন রূচিবান স্বদেশবানদের
সুনামের হুরহুরি। বহুদিন আগে কোনও একজন বলছিলো, আমাদের দেশের মানুষ নিজের দেশের পণ্য বিদেশ ফেরত হইলে তা বেশি দাম দিয়া
কিনতে আগ্রহ দেখায়। কারণ ঐটা বিদেশী পণ্য। কিন্তু
নিজের দেশের পণ্যটারে নিজের ব্যবহারের উপযুক্ত মনে করে না। অথচ
এই দেশের আলো বাতাসেই আমরা বড় হইছি। বড় হওয়ার পর প্রয়োজন মনে করি বিদেশী
পণ্য। সাকিবকে নিয়া অতি মাতামাতির কারণে আমার এই রকম মনে হইছে আর কি। তবে মাতামাতি ভালো। বিশেষ করে সব ধরণের তারকাদের নিয়েই তো মাতামাতি হবে। নইলে তারা তারকা কেনো? তবে যাদেরকে কখনো সাকিবের
ছবি হলে গিয়ে দেখতে শুনি নাই। তারাই যখন সাকিব নিয়ে মাতামাতি শুরু করলেন তখন কিছুটা
প্রশ্ন জাগতেই পারে। সেই কারণে ‘শিকারি’ দেখার আগ্রহ
তৈরি হয়।
এর আগে অবশ্য একটা কথা না বললেই নয়। তা হইলো
আমি নিয়মিত হলে গিয়া বাংলা সিনেমা দেখি। এই কথা শুইন্যা অনেকের চক্ষু কপালেও
উঠে। আমার অবশ্য মুচকি মুচকি হাসি পায়। কারণ,
ঐ কপালে ওঠা চোখ দেখতে আমার ভাল্লাগে। একই
সাথে ছবির কয়েকটা গান দেখে মনে হইছে সাকিবের নতুন লুক, সব্যসাচী
চক্রবর্তিও অভিনয় করতেছে। ছবিটা দেখাই উচিত। তাই
ঈদের দিন অর্ধেক ঘুম বাতিল করে জয়কে ডেকে আনলাম ছবি দেখার জন্য। সে আসতে আসতে ১০ মিনিট ছবি চলে গেছে।
হলে ঢুকে দেখি কোনও এক ধর্মগুরু পূজার
জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর তার সাথে তার সমর্থক ভক্তঅনুরাগিরা উৎসব করছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রফেশনাল কিলার হিরো সাকিব। এবং
কার্য সমাধা করার পরই মূল গল্পে ঢুকে গেলো সিনেমা। ভালোই
খারাপ না। ফর্মুলা ছবি হিসেবে টানটান গল্প রাখার চেষ্টা। একটা ঘটনা শেষ হতে না হতেই আর একটা ঘটনা। যদিও
সবগুলো ঘটনাই ঘটতে যাবে অনুমিত। সেইসব অনুমিত ঘটনাগুলোই দেখা যাচ্ছিল
অপেক্ষাকৃত ভালো নির্মাণে। অপেক্ষাকৃত ভালো অর্থে বলছি এই কারণে যে,
বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশী বা ভারতীয় বাংলা সিনেমার যেই নির্মাণ
মান তার সাথে এর একটু পার্থক্য আছে। পার্থক্যটা কেমন? এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিছুদিন আগেও আমরা দেখে এসেছি
সিনেমা চারটা গানের তিনটাই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দৃশ্যায়ন। যার
কোরিগ্রাফার হয়ত কোনও ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। ঐ গানগুলোকে
বারবার দেখিয়ে দেখিয়ে লোকজনকে হলে নেয়া হতো, আর ছবির নির্মাণহতো
বাংলাদেশী গড়পড়তা টিভি নাটকের চেয়ে একটু ভালো। তো ঐ
রকম একটা আশঙ্কা নিয়েই ছবি দেখতে বসেছিলাম। কিন্তু সেই আশঙ্কা পুরোপুরি মিলে
নি। তাই কিছুটা সন্দেহও ছিলো। পশ্চিমবঙ্গের নির্মাতারা এই রকম
বাণিজ্যিক ছবি কি আসলেই বানাতে শুরু করে দিলেন? হ্যা,
এই প্রশ্নটাই বাংলাদেশের সিনেমার টার্নিং পয়েন্টের একটা প্রশ্ন। কারণ ফেসবুক মারফতই না, বাস্তবেও দেখলাম সিনেমা
হল ভর্তি লোকজন। বিকাল সাড়ে পাঁচটার টিকিট তাই অগ্রীম বিক্রি হয়ে
যাচ্ছে দুপুর ১টায়। যা বিগত কয়েক বছরে কল্পনাতীত। সেই কল্পনা যদি বাস্তব হয় তবে প্রশ্ন আসতে পারে, বাংলা সিনেমা কি তবে সুদিন ফিরে পাচ্ছে? এই প্রশ্নের
উত্তরে বলবো ধীরে বৎস, ধীরে। এই প্রশ্নের
উত্তরের সাথে বাংলা সিনেমার টার্নিং পয়েন্টের প্রশ্নের উত্তরটাও চলে আসে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের নির্মাতারা যদি এই মানের ছবিও
নিয়মিত বানায় আর তা অনায়াসে আমাদের সিনেমাহলের দর্শকরা লুফে নেবে। কারণ আমাদের বাংলাদেশের নির্মাতারা এতটুকুও বানাতে পারছেন না। এমনকি অনেক নামি দামি নির্মাতাদের ছবিও তাই বলে। ফলে
কলকাতার নির্মাতারা হলে জায়গা পাকা করে নিলে এফডিসিতে এখনো যেমন কিছু সিনেমার কাজ চলে,
তখন আর কিছুই চলবে না। তখন বরংচ সেইসব নির্মাতাদের দক্ষিণী
কুশলীদের ভাড়া করা ছাড়া উপায় থাকবে না। তাই নিজেদের মান উন্নয়ন খুব জরুরী। ঘরের দর্শকদের জন্য, নিজেদের জন্য, নিজেদের সিনেমার জন্য তো বটেই।
এতক্ষণ ধান বানতে গিয়ে শীবের গীত শোনালাম। কি আর করা, কখনো কখনো বৃষ্টির চেয়ে ছাতাই গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে উঠে কি না! তো ‘শিকারি’ একদম গতানুগতিক
একটা ফর্মুলা ছবি। যার গানগুলোতে আমাদের দেশী নায়ক সাকিবকে নতুন লুকে
দেখা গেছে। যা বড় পর্দায় দেখে আপনার ভালো লাগবে নিঃসন্দেহে। পুরো ছবির সবচে আরামদায়ক ভিজ্যুয়াল বলতে ঐ গানগুলোই। তবে হ্যা, আনুপাতিক হারে ছবির যে নির্মাণ তা মন্দের
ভালো। অন্তত এই কোয়ালিটিই আপাতত পাতে জুটছে যে এই বেশি। এই প্রসঙ্গে
জেনে নেয়া যাক ছবির নির্মাতার নাম। বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ প্রযোজনার
ছবির প্রসঙ্গ আসলেও বাংলাদেশী যেই পরিচালকের নাম আমরা জানলাম সেই পরিচালকের নাম জাকির
হোসেন সীমান্ত। আর ভারতের অংশের পরিচালক ছিলেন জয়দ্বীপ মুখার্জি। আইএমডিবি সূত্র বলে জয়দ্বীপ আগে টিভি নির্মাতা ছিলেন। বেশ কয়েকটি টিভি সিরিয়াল তিনি বানাইছেন। তার
মাঝে ব্যোমকেশ উল্লেখযোগ্য একটি। তবে দুই দেশের ছবি হইলেও বাংলাদেশের
কোনও অংশই ছবির ছিলো না। এইটা নামকাওয়াস্তে কেবল।
ছবির গল্প নিয়ে অভিযোগ করতে চাই না। কারণ, গল্প নিয়ে প্রত্যাশাই ছিলো না। সেই তুলনায় অনেক ভালো গল্প ও চিত্রনাট্য। তবে
গল্প চিত্রনাট্যের চেয়ে বেশ কিছু মজার ছিলো ছবির সংলাপ। এবার
আসুন জানি, ছবির গল্পকার ও চিত্রনাট্যকার কে বা কারা। ছবির চিত্রনাট্য বিষয়ক তথ্য খুঁজতে গিয়ে দুই প্রকার তথ্য পাওয়া গেলো। উইকিপিডিয়া বলছে পেলে ভট্টাচার্যই ও আব্দুল্লাহ জহির বাবু ছবির চিত্রনাট্য
ও সংলাপ লিখেছে। আবার আইএমডিবি বলছে জয়দ্বীপ মুখার্জি ও পেলে ভট্টাচার্য
দুজন মিলে লিখেছে। আসল সত্য কোনটা তারাই জানে।
ছবিতে সব্যসাচী চক্রবর্তীর অভিনয় দেখার
লোভ ছিলো। তাতে টান পড়েছে। উল্টো
দুই জনের অভিনয়ে বিনোদিত হয়েছি। তার একজন হিন্দী ছবির ভিলেন রাহুল
দেব আর একজন কলকাতার অভিনয়শিল্পী খরাজ মুখোপাধ্যায়। তবে
এইসব ভালো মন্দের চেয়ে সবচে বেশী যা ভালো লেগেছে তা হলো ছবি দেখার জন্য মানুষের হলে
ভীড় করা দেখে। কারণ ভালো মন্দ তো পরে, আগে তো ছবিটা দেখতে হবে। নইলে ছবি হবে না ভবিষ্যতে।
শেষ পর্যন্ত যেই কথা বলতে চাই তা হলো
এই ছবি লোকজন মজা করে দেখবে। ভুলে যাবে। মনপুড়া
ছবি দেখে আমরা যেমন বেশ কয়েকদিন আলোচনা করেছি। কেউ
কেউ একাধিকবারও দেখেছি, এই ছবি তেমন নয়। কিন্তু চকচকে ঝকঝকে বলে লোকজনের আগ্রহটাও চকচকেই। আর এমন
আগ্রহ তৈরি করতে না পারলে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ছবি আর বানাইতে হবে না। কারওয়ান বাজারের মাছ ব্যবসা অনেক ভালো তার চেয়ে।
2 মন্তব্য(গুলি):