বুধবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১২

একটা সন্ধ্যার কথা আমরা ভুলে যেতে পারি, কিংবা ভুলে যেতে পারি একটা মৃত্যু সম্ভাবনার কথাও- কিন্তু একটি শাদা অর্ন্তবাস অথবা তার স্বত্তাধিকারীর কথা ভুলে যেতে গিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে পারি; কিন্তু ভাবিনা, কারণ আমরা ভেবে দেখেছি উন্মোক্ত গ্যালারীতে রাখা চিত্রকর্মের সহজলভ্যতা একটি স্বতঃস্ফুর্ত শিল্প আকাঙ্খা জন্মদিলেও ধরা দেয়না স্বতন্ত্র একটি ভাবন- তারপরও আমরা খুঁজি চারপাশে সেই অর্ন্তবাসের স্বত্তাধিকারীকে অথবা তার মতো আরো আরো কিংবদন্তীকে, যারা প্রতিদিন স্বেচ্ছামৃত্যুর ইচ্ছা পোষন করতে গিয়ে রাত জাগে আর আলোকিত করে ছা-পোশা শয্যা- যা আমাদের হতে পারতো আরো দীর্ঘ মৃত্যু আকাঙ্খার জাগ্রত সময়ে; কিন্তু আমরা ভুলে যাই না, এই মৃত্যু একটি সময়ের ছোটগল্প মাত্র- যা কিনা প্রতিদিন সকাল হলেই পাঠক তার ওয়েস্টপ্যাপারের বাক্সে ছুরে দিতে পারে

প্রতিদিন সকালের ঝালমুরি ওয়ালা এক বস্তা ঝালমুড়ি দিয়ে গেলে আমরা লেবুপাতার বাগানে তা শোকাতে দিই জেনেও সেখানে কোনও ঝালমুড়ির দোকান হয় না, এ খবর শুনে আপনি আনন্দিত হতে পারেন জানি; কিন্তু আপনার স্ত্রীর কি শরীর ভালো?

ওয়েস্টপ্যাপার বক্স

at বুধবার, নভেম্বর ২৮, ২০১২  |  No comments

একটা সন্ধ্যার কথা আমরা ভুলে যেতে পারি, কিংবা ভুলে যেতে পারি একটা মৃত্যু সম্ভাবনার কথাও- কিন্তু একটি শাদা অর্ন্তবাস অথবা তার স্বত্তাধিকারীর কথা ভুলে যেতে গিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে পারি; কিন্তু ভাবিনা, কারণ আমরা ভেবে দেখেছি উন্মোক্ত গ্যালারীতে রাখা চিত্রকর্মের সহজলভ্যতা একটি স্বতঃস্ফুর্ত শিল্প আকাঙ্খা জন্মদিলেও ধরা দেয়না স্বতন্ত্র একটি ভাবন- তারপরও আমরা খুঁজি চারপাশে সেই অর্ন্তবাসের স্বত্তাধিকারীকে অথবা তার মতো আরো আরো কিংবদন্তীকে, যারা প্রতিদিন স্বেচ্ছামৃত্যুর ইচ্ছা পোষন করতে গিয়ে রাত জাগে আর আলোকিত করে ছা-পোশা শয্যা- যা আমাদের হতে পারতো আরো দীর্ঘ মৃত্যু আকাঙ্খার জাগ্রত সময়ে; কিন্তু আমরা ভুলে যাই না, এই মৃত্যু একটি সময়ের ছোটগল্প মাত্র- যা কিনা প্রতিদিন সকাল হলেই পাঠক তার ওয়েস্টপ্যাপারের বাক্সে ছুরে দিতে পারে

প্রতিদিন সকালের ঝালমুরি ওয়ালা এক বস্তা ঝালমুড়ি দিয়ে গেলে আমরা লেবুপাতার বাগানে তা শোকাতে দিই জেনেও সেখানে কোনও ঝালমুড়ির দোকান হয় না, এ খবর শুনে আপনি আনন্দিত হতে পারেন জানি; কিন্তু আপনার স্ত্রীর কি শরীর ভালো?

Read More

0 মন্তব্য(গুলি):

যতটা পথ হেটেছে সে কিশোর বেলায়
তারচেয়ে আপন হয়েছে আজ
মরিচ বাগানের ঘ্রাণ,

বন্ধুর নামের আগে কেনো লিখে রাখে কৃষ্ণচূড়া ফুলের নাম
কেনো তার ভাত ঘুমে স্বপ্নেরা হানা দেয়
তাই বুছি জোছনার গান গাওয়া রাজহাঁস-
শুষুকের ভাগ্য ফেরায়

হাতে রেখে সু-সময়ের দিন, তোমাকে তাই বন্ধু হতে ডাকি-
      কেমন আছো জলের ঈশ্বর?
তাদের মুখরে কি সুখনিদ্রা আসে?
মাঝে মাঝে তাই ঋতুর বন্ধু হয়ে যাই
রোদ বৃষ্টি ফেরি করে বেরাই নগরের জানালায়
মানুষের ভাগ্য কি সেই রোদের বন্ধু হয়-
কি থাকে তাই অস্তিত্বের বিবর্ণ ইতিহাসে,
তার কথা লিখে রাখবে রোদের ডায়রী

খুব বেশী রোদ নেই বৃক্ষের

at বুধবার, নভেম্বর ২৮, ২০১২  |  No comments

যতটা পথ হেটেছে সে কিশোর বেলায়
তারচেয়ে আপন হয়েছে আজ
মরিচ বাগানের ঘ্রাণ,

বন্ধুর নামের আগে কেনো লিখে রাখে কৃষ্ণচূড়া ফুলের নাম
কেনো তার ভাত ঘুমে স্বপ্নেরা হানা দেয়
তাই বুছি জোছনার গান গাওয়া রাজহাঁস-
শুষুকের ভাগ্য ফেরায়

হাতে রেখে সু-সময়ের দিন, তোমাকে তাই বন্ধু হতে ডাকি-
      কেমন আছো জলের ঈশ্বর?
তাদের মুখরে কি সুখনিদ্রা আসে?
মাঝে মাঝে তাই ঋতুর বন্ধু হয়ে যাই
রোদ বৃষ্টি ফেরি করে বেরাই নগরের জানালায়
মানুষের ভাগ্য কি সেই রোদের বন্ধু হয়-
কি থাকে তাই অস্তিত্বের বিবর্ণ ইতিহাসে,
তার কথা লিখে রাখবে রোদের ডায়রী

Read More

0 মন্তব্য(গুলি):

মঙ্গলবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১২

২৭ নভেম্বর আমার আব্বার মৃত্যুদিন। ২০০২ সালের এই দিনে আমি আমার আব্বাকে হারিয়েছিলাম। সেই সময়কার আমি আর এই সময়কার আমি’র মাঝে আমি নিজেই অনেক পার্থক্য দেখতে পাই। দেখতে পাই, আব্বার সাথে আমার অনেক মিল, অমিল। অমিলগুলোর জন্য নিজেকে এর মালিক মনে করি। মিলগুলোর জন্য মনে করি আমার জিন কে। যা আমার আব্বা-আম্মারকাছ থেকে আমি পেয়েছে। আর এই দিকটায় পরিবারের আমার অন্য সব ভাইদের চেয়ে মনে হয় আমার বাবার সাথে আমার মিল একটু বেশী। এটা হয়তো আমি নির্মোহভাবে দেখতে পারি না। নিজেকে যতটুকু জানি বলে মনে করি, ততটুকু দিয়েই। আর তাই ভুল হবার সম্ভাবনাও থাকে।
আমার বাবাকে আমি বা আমরা কখনোই একজন স্নেহাশিষ পিতা হিসেবে পাই নি। যা আমি আমার চারপাশে দেখে এসেছি। আর তাই সেই ছোটবেলা থেকেই আব্বার প্রতি একটা বিতৃষ্ণা আমার ছিলো। আমি তাকে একটা এলোমেলো বদমেজাজি মানুষ হিসেবেই চিনে এসেছি। তবে হ্যা, এই লোকটির সংগ্রামের কথা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। তিনি কখনোই স্বচ্ছল থাকতে পারেন নি। সারা জীবন কাটিয়েছেন টানাপোড়েনের মধ্যে। দেখে এসেছি তার অসম্ভব পরিশ্রম করার জীবনকে। তবে আমি যা দেখেছি, তা নাকি খুবই সামান্য। তবুও তিনি আমার দেখা জীবনের মাঝে কিছুটা রয়েছেন। এই ভেবে আনন্দিতও হই।
আমার আব্বা আমাদের পূর্বজ পরিবারের প্রথম পড়ালেখা জানা (মেট্রিক পাশ) মানুষ ছিলেন। তার বাবা, মানে আমার দাদা ছিলেন আমাদের কাছে বিপ্লবী। তবে সেই বিপ্লবী মানষিকতা আমার কাছে কাপুরুষোচিত বলে মনে হয় এখন। আব্বার মুখেই তার কথা শুনেছি বেশী। কিছু শুনেছি আম্মার কাছে, কিছু নানী আর ফুপুর কাছে। আমার আব্বাকে আমি কাউকে ভয় পেতে দেখি নাই। কেবল তার বড় বোন, আমাদের একমাত্র ফুপুকে ছাড়া। ফুপুর চেয়ে দশ বছর কম ছিলো আমার আব্বার। কিন্তু আব্বাই আগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ফুপু অনেক বয়সে দীর্ঘ রোগে ভোগে তারপর পৃথিবী ছেরেছিলেন। কোনও এক আশ্চর্য কারণে আমার ফুপু আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তিনি আমাদের সব ভাই বোনদের কে বা’জি আর মায়া’জি বলে ডাকতেন। কিন্তু আমাকে ডাকতেন বাজান বলে। আমাকে কাছে পেলে তার ভালোবাসা প্রকাশের মাত্রাও বেড়ে যেতো। আমি তার সেই ভালোবাসা এখন বুঝি, তখন বুঝতাম না। পরবর্তিতে মায়ের কাছে শুনেছি, আমার বাবাও ছিলেন তার অন্য ভাইদের চেয়ে বেশী আপন। আমি সেই সূত্রে হিসাব মেলাই, আমার মাঝে কি তিনি তার ছোটভাইটাকে দেখেছিলেন? হয়তো, হয়তো না। তার মুখ আমার কাছে অস্পষ্ট হতে শুরু করেছে। তিনি মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত এখনকার মত ছবি তোলা এত হাতের নাগালে ছিলো না, তবে সুযোগ যে ছিলো না তা কিন্তু নয়। আমি তবুও ছবির চেয়ে আমার স্মৃতির ফুপুকেই মনে করতে পছন্দ করি। তিনি থাকুক আমার হৃদয়ের এ্যালবামে।
২০০২ সালে আমি ইন্টারমিডিয়েটে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। আব্বা চাকরি থেকে রিটায়ার্ড করেছেন ততদিনে অনেক দিন। অনেক দিন বলতে ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি অবসর নেন। তার পর থেকে অফিস পাগল একটা তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারির দিন কাটতো না। নানা ধরনের কাজে তিনি ব্যস্ত থাকতে চেষ্টা করতেন। এই অবসর আমাদের জন্য যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কারণ, আমরা তার প্রচণ্ড বদমেজাজী মানুষটাকে সব সময় সামনে প্রত্যাশা করতাম না। কিন্তু এই মানুষটা বদ মেজাজী হলেও ভেতরটা ছিলো একদম স্বচ্ছ। কোনও রাখঢাক তিনি মনের ভেতর পুষে রাখতেন না। এই সভ্য সমাজে মানুষ যেভাবে ক্ষোভ বিতৃষ্ণা পুষে রেখে প্রতিষোধ পরায়ন হয়ে ওঠে, তিনি তেমন কখনই ছিলেন না। তার সরলতার জন্য তাকে আমাদের সব প্রতিবেশীই একটা ভালো মানুষ বলে জানতেন।
এই ভালো মানুষটা স্থুল অর্থে জীবনে কিছু করতে পারেন নি। করতে পারেন নি এ কথাও বলা যায় না। কারণ, আমি যখন জানতে পারি, তখন তার সমগ্র বেতন মাত্র ১০ হাজার টাকা মাত্র। এটাও বেশদিন আগের ঘটনা নয়, ১৯৯৬/৯৭ সালের ঘটনা। এ সময় আমরা ৬ ভাইয়ের মাত্র একজন রোজগার করতে পারে। একজন পৃথক থাকায় তার রোজগার আমাদের পরিবারের সাথে যোগ হয় না, বাকী চারজনই পড়াশোনা করি। এই সংসারটাকে তিনি টেনে ধরে রাখতে পেরেছিলেন। তা কি কম কিছু? এখন টের পাই, এও অনেক কিছু। যা একটা উল্লেখযোগ্য দিক বলে ভাবতে পারি আমি।
আব্বা বরাবরই আদর্শবাদী মানুষ ছিলেন। তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারি হলেও তার কর্মদক্ষতার কারণে তিনি তার ডিপার্টম্যান্টের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে সমীহ জাগানো ব্যক্তি ছিলেন। তার সম পর্যায়ের অবস্থান থেকে আমাদের চোখের সামনেই আমরা দেখেছি বাড়ি গাড়ি করে ফেলতে। আর আমার বাবাকে দেখেছি বাজারে ২ টাকা বাঁচানোর জন্য পুরো বাজার ঘুরে, দামাদামি করে তারপর কিনতে।
এই লোকটার অতীতের কথা ভাবলে আমি আরও আশ্চর্য হই। এই লোকটাই আদমজি জুট মিলের ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলো এক সময়। পুরো জুট মিল তার ভয়ে কাঁপতো। সেখানেও তার সম সাময়িকদের দুর্নীতি থেকে প্রতিষ্ঠান ও নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে যে সংগ্রাম করেছিলেন তিনি, তার কথা বলার সময় তার গলা ভারি হয়ে আসতো। আর তার চোখ ভিজে আসতো। আশ্চর্যের বিষয়, এসব আমরা টেরই পাইনি তখন। এখন টের পাই।
আব্বার স্মৃতিগুলো, চারিত্রিক ধর্মগুলো বর্ণনা করি। আর ভাবি, আমার এই অবস্থায় থাকলে তিনি কি করতেন? তিনি কি ভাবতেন? পারিনা। তার মতো করে ভাবতে পারি না। আমি আমার মতোই ভাবি। কারণ, আমি যে দলছুট হয়ে গেছি আরও অনেক আগেই। আমি যে বুঝতে শিখেছি আমার মতো করে চলে না আমার ছেলেবেলার বন্ধুরাই। তবে নিজেকে কখনোই দশজনের বাইরের ভাবিনি, ভেবেছি দশজনের সবার শেষের জন।
তাঁর মৃত্যুর একদিন আগে সন্ধ্যায় ইফতার করতে বসে হঠাৎ ইফতার করতে করতে উঠে গেলেন। বমি হলো তার। মাথায় প্রচুর পানি ঢালা হলো, কিন্তু প্রেসার বেরে যাওয়ায় কিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না। ডাক্তার ডাকা হলো, ডাক্তার ওষুধ দিলো, সেলাইন দিলো, শরীরের অবস্থা খারাপও না ভালোও না বুঝতেই পারছিলাম না। একদিন বাড়িতেই চিকিৎসা চললো, পরদিন সন্ধ্যার আগে অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেলে দেখাগেলো শরীরের একটা দিক তার অবশ হয়ে গেছে। মেজর স্ট্রোক। বাবার গোড়ামি আর আমাদের অজ্ঞতা ও ডাক্তারের ভুল সিদ্ধান্ত। সব মিলে আমরা একটা প্যারালাইজড বাবাকে ঘরে পরে থাকতে দেখবো এমন মানষিক প্রস্তুতি তখন আমার। এই অবস্থায় জরুরী ময়মনসিংহ মেডিকেলে নেওয়া হলো তাকে। আমার তখন সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলে। সকালে সেহরি খেয়ে আমার বোনের বাড়ি গিয়ে খবর দিয়ে এলাম। বোন ও দুলাভাইকে বললাম- আব্বা খুব অসুস্থ্য, ময়মনসিংহ মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। পারলে একবার গিয়ে দেখে আসবেন। তাদের জানিয়ে আমি পরীক্ষায় বসে যাই। আমার এই বোনটি আমার একমাত্র বোন। আমার জন্মের পর থেকে আমার মা আমার জন্য যা করেছে, সে করেছে তার চেয়েও বেশী। এতে অবশ্য আমি মাকে দোষ দেই না। কারণ, এমন কিছুত হয়ই। সেই বোনটা বাবার খুব আদরের। আমাদের ছয় ভাই ও আম্মার কথা না শুনলেও বাবা আমার বোনটির কথা শুনতেন। হয়তো একমাত্র বলেই। পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরে দেখি বোন বাসায় বসে আছে। আর দেরি করা হলো না। তাকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা দেয়া হলো। বাসে উঠেই মনে হচ্ছিলো গতকাল সন্ধ্যায় যে বাবাকে আমি প্রাণসহ দেখেছি, ঐ জ্যান্ত বাবাকে হয়তো আমি আর পাবো না। হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকতেই পেলাম সেজো ভাইকে তার এক বন্ধুর সাথে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখমুখ লাল। মনে হচ্ছে রক্ত জমে আছে। আর একটু ভেতরে ঢুকতেই হাসপাতালে ফোন ফ্যাক্সের একটা দোকানে দেখলাম মেজোভাই কে। আমি আরও সুদৃঢ় হয়ে গেলাম, আমি যা ভাবছি তাই হতে যাচ্ছে। হাসাপাতালের ছয় তলার সিড়িগুলোকে আমার বড় দীর্ঘপথ বলে মনে হচ্ছিলো। বলতে গেলে এক দৌড়েই চললাম পেয়িং ওয়ার্ডটায়। ওয়ার্ডে ঢুকতেই আর আমার ইমিডিয়েট বড় ভাইটা আপাকে দেখে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। আমরা ওয়ার্ডের শেষ মাথায় এসে দেখলাম, সবার বড় ভাই বাবার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছে। ডাক্তার বাবার মুখটাও ঢেকে দিয়েছেন একটা চাঁদর দিয়ে। তার পর থেকে আমার বাবাকে ঘিরে জমেথাকা বাস্তবগুলো অতীত হওয়া শুরু করলো। আজ তাঁর মৃত্যুর এক দশক পর এসে মনে হচ্ছে, নানা দিক থেকে সফল হওয়ার চেষ্টা করা একটা ব্যার্থ মানুষ আমার বাবা। আর আমি কি আপনার সেই সন্তান? যে কিনা এখনো সফল হওয়ার স্বপ্নই দেখে যাচ্ছি কেবল?

আমিই আমার বাবার আয়না

at মঙ্গলবার, নভেম্বর ২৭, ২০১২  |  2 comments

২৭ নভেম্বর আমার আব্বার মৃত্যুদিন। ২০০২ সালের এই দিনে আমি আমার আব্বাকে হারিয়েছিলাম। সেই সময়কার আমি আর এই সময়কার আমি’র মাঝে আমি নিজেই অনেক পার্থক্য দেখতে পাই। দেখতে পাই, আব্বার সাথে আমার অনেক মিল, অমিল। অমিলগুলোর জন্য নিজেকে এর মালিক মনে করি। মিলগুলোর জন্য মনে করি আমার জিন কে। যা আমার আব্বা-আম্মারকাছ থেকে আমি পেয়েছে। আর এই দিকটায় পরিবারের আমার অন্য সব ভাইদের চেয়ে মনে হয় আমার বাবার সাথে আমার মিল একটু বেশী। এটা হয়তো আমি নির্মোহভাবে দেখতে পারি না। নিজেকে যতটুকু জানি বলে মনে করি, ততটুকু দিয়েই। আর তাই ভুল হবার সম্ভাবনাও থাকে।
আমার বাবাকে আমি বা আমরা কখনোই একজন স্নেহাশিষ পিতা হিসেবে পাই নি। যা আমি আমার চারপাশে দেখে এসেছি। আর তাই সেই ছোটবেলা থেকেই আব্বার প্রতি একটা বিতৃষ্ণা আমার ছিলো। আমি তাকে একটা এলোমেলো বদমেজাজি মানুষ হিসেবেই চিনে এসেছি। তবে হ্যা, এই লোকটির সংগ্রামের কথা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। তিনি কখনোই স্বচ্ছল থাকতে পারেন নি। সারা জীবন কাটিয়েছেন টানাপোড়েনের মধ্যে। দেখে এসেছি তার অসম্ভব পরিশ্রম করার জীবনকে। তবে আমি যা দেখেছি, তা নাকি খুবই সামান্য। তবুও তিনি আমার দেখা জীবনের মাঝে কিছুটা রয়েছেন। এই ভেবে আনন্দিতও হই।
আমার আব্বা আমাদের পূর্বজ পরিবারের প্রথম পড়ালেখা জানা (মেট্রিক পাশ) মানুষ ছিলেন। তার বাবা, মানে আমার দাদা ছিলেন আমাদের কাছে বিপ্লবী। তবে সেই বিপ্লবী মানষিকতা আমার কাছে কাপুরুষোচিত বলে মনে হয় এখন। আব্বার মুখেই তার কথা শুনেছি বেশী। কিছু শুনেছি আম্মার কাছে, কিছু নানী আর ফুপুর কাছে। আমার আব্বাকে আমি কাউকে ভয় পেতে দেখি নাই। কেবল তার বড় বোন, আমাদের একমাত্র ফুপুকে ছাড়া। ফুপুর চেয়ে দশ বছর কম ছিলো আমার আব্বার। কিন্তু আব্বাই আগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ফুপু অনেক বয়সে দীর্ঘ রোগে ভোগে তারপর পৃথিবী ছেরেছিলেন। কোনও এক আশ্চর্য কারণে আমার ফুপু আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তিনি আমাদের সব ভাই বোনদের কে বা’জি আর মায়া’জি বলে ডাকতেন। কিন্তু আমাকে ডাকতেন বাজান বলে। আমাকে কাছে পেলে তার ভালোবাসা প্রকাশের মাত্রাও বেড়ে যেতো। আমি তার সেই ভালোবাসা এখন বুঝি, তখন বুঝতাম না। পরবর্তিতে মায়ের কাছে শুনেছি, আমার বাবাও ছিলেন তার অন্য ভাইদের চেয়ে বেশী আপন। আমি সেই সূত্রে হিসাব মেলাই, আমার মাঝে কি তিনি তার ছোটভাইটাকে দেখেছিলেন? হয়তো, হয়তো না। তার মুখ আমার কাছে অস্পষ্ট হতে শুরু করেছে। তিনি মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত এখনকার মত ছবি তোলা এত হাতের নাগালে ছিলো না, তবে সুযোগ যে ছিলো না তা কিন্তু নয়। আমি তবুও ছবির চেয়ে আমার স্মৃতির ফুপুকেই মনে করতে পছন্দ করি। তিনি থাকুক আমার হৃদয়ের এ্যালবামে।
২০০২ সালে আমি ইন্টারমিডিয়েটে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। আব্বা চাকরি থেকে রিটায়ার্ড করেছেন ততদিনে অনেক দিন। অনেক দিন বলতে ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি অবসর নেন। তার পর থেকে অফিস পাগল একটা তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারির দিন কাটতো না। নানা ধরনের কাজে তিনি ব্যস্ত থাকতে চেষ্টা করতেন। এই অবসর আমাদের জন্য যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কারণ, আমরা তার প্রচণ্ড বদমেজাজী মানুষটাকে সব সময় সামনে প্রত্যাশা করতাম না। কিন্তু এই মানুষটা বদ মেজাজী হলেও ভেতরটা ছিলো একদম স্বচ্ছ। কোনও রাখঢাক তিনি মনের ভেতর পুষে রাখতেন না। এই সভ্য সমাজে মানুষ যেভাবে ক্ষোভ বিতৃষ্ণা পুষে রেখে প্রতিষোধ পরায়ন হয়ে ওঠে, তিনি তেমন কখনই ছিলেন না। তার সরলতার জন্য তাকে আমাদের সব প্রতিবেশীই একটা ভালো মানুষ বলে জানতেন।
এই ভালো মানুষটা স্থুল অর্থে জীবনে কিছু করতে পারেন নি। করতে পারেন নি এ কথাও বলা যায় না। কারণ, আমি যখন জানতে পারি, তখন তার সমগ্র বেতন মাত্র ১০ হাজার টাকা মাত্র। এটাও বেশদিন আগের ঘটনা নয়, ১৯৯৬/৯৭ সালের ঘটনা। এ সময় আমরা ৬ ভাইয়ের মাত্র একজন রোজগার করতে পারে। একজন পৃথক থাকায় তার রোজগার আমাদের পরিবারের সাথে যোগ হয় না, বাকী চারজনই পড়াশোনা করি। এই সংসারটাকে তিনি টেনে ধরে রাখতে পেরেছিলেন। তা কি কম কিছু? এখন টের পাই, এও অনেক কিছু। যা একটা উল্লেখযোগ্য দিক বলে ভাবতে পারি আমি।
আব্বা বরাবরই আদর্শবাদী মানুষ ছিলেন। তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারি হলেও তার কর্মদক্ষতার কারণে তিনি তার ডিপার্টম্যান্টের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে সমীহ জাগানো ব্যক্তি ছিলেন। তার সম পর্যায়ের অবস্থান থেকে আমাদের চোখের সামনেই আমরা দেখেছি বাড়ি গাড়ি করে ফেলতে। আর আমার বাবাকে দেখেছি বাজারে ২ টাকা বাঁচানোর জন্য পুরো বাজার ঘুরে, দামাদামি করে তারপর কিনতে।
এই লোকটার অতীতের কথা ভাবলে আমি আরও আশ্চর্য হই। এই লোকটাই আদমজি জুট মিলের ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলো এক সময়। পুরো জুট মিল তার ভয়ে কাঁপতো। সেখানেও তার সম সাময়িকদের দুর্নীতি থেকে প্রতিষ্ঠান ও নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে যে সংগ্রাম করেছিলেন তিনি, তার কথা বলার সময় তার গলা ভারি হয়ে আসতো। আর তার চোখ ভিজে আসতো। আশ্চর্যের বিষয়, এসব আমরা টেরই পাইনি তখন। এখন টের পাই।
আব্বার স্মৃতিগুলো, চারিত্রিক ধর্মগুলো বর্ণনা করি। আর ভাবি, আমার এই অবস্থায় থাকলে তিনি কি করতেন? তিনি কি ভাবতেন? পারিনা। তার মতো করে ভাবতে পারি না। আমি আমার মতোই ভাবি। কারণ, আমি যে দলছুট হয়ে গেছি আরও অনেক আগেই। আমি যে বুঝতে শিখেছি আমার মতো করে চলে না আমার ছেলেবেলার বন্ধুরাই। তবে নিজেকে কখনোই দশজনের বাইরের ভাবিনি, ভেবেছি দশজনের সবার শেষের জন।
তাঁর মৃত্যুর একদিন আগে সন্ধ্যায় ইফতার করতে বসে হঠাৎ ইফতার করতে করতে উঠে গেলেন। বমি হলো তার। মাথায় প্রচুর পানি ঢালা হলো, কিন্তু প্রেসার বেরে যাওয়ায় কিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না। ডাক্তার ডাকা হলো, ডাক্তার ওষুধ দিলো, সেলাইন দিলো, শরীরের অবস্থা খারাপও না ভালোও না বুঝতেই পারছিলাম না। একদিন বাড়িতেই চিকিৎসা চললো, পরদিন সন্ধ্যার আগে অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেলে দেখাগেলো শরীরের একটা দিক তার অবশ হয়ে গেছে। মেজর স্ট্রোক। বাবার গোড়ামি আর আমাদের অজ্ঞতা ও ডাক্তারের ভুল সিদ্ধান্ত। সব মিলে আমরা একটা প্যারালাইজড বাবাকে ঘরে পরে থাকতে দেখবো এমন মানষিক প্রস্তুতি তখন আমার। এই অবস্থায় জরুরী ময়মনসিংহ মেডিকেলে নেওয়া হলো তাকে। আমার তখন সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলে। সকালে সেহরি খেয়ে আমার বোনের বাড়ি গিয়ে খবর দিয়ে এলাম। বোন ও দুলাভাইকে বললাম- আব্বা খুব অসুস্থ্য, ময়মনসিংহ মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। পারলে একবার গিয়ে দেখে আসবেন। তাদের জানিয়ে আমি পরীক্ষায় বসে যাই। আমার এই বোনটি আমার একমাত্র বোন। আমার জন্মের পর থেকে আমার মা আমার জন্য যা করেছে, সে করেছে তার চেয়েও বেশী। এতে অবশ্য আমি মাকে দোষ দেই না। কারণ, এমন কিছুত হয়ই। সেই বোনটা বাবার খুব আদরের। আমাদের ছয় ভাই ও আম্মার কথা না শুনলেও বাবা আমার বোনটির কথা শুনতেন। হয়তো একমাত্র বলেই। পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরে দেখি বোন বাসায় বসে আছে। আর দেরি করা হলো না। তাকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা দেয়া হলো। বাসে উঠেই মনে হচ্ছিলো গতকাল সন্ধ্যায় যে বাবাকে আমি প্রাণসহ দেখেছি, ঐ জ্যান্ত বাবাকে হয়তো আমি আর পাবো না। হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকতেই পেলাম সেজো ভাইকে তার এক বন্ধুর সাথে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখমুখ লাল। মনে হচ্ছে রক্ত জমে আছে। আর একটু ভেতরে ঢুকতেই হাসপাতালে ফোন ফ্যাক্সের একটা দোকানে দেখলাম মেজোভাই কে। আমি আরও সুদৃঢ় হয়ে গেলাম, আমি যা ভাবছি তাই হতে যাচ্ছে। হাসাপাতালের ছয় তলার সিড়িগুলোকে আমার বড় দীর্ঘপথ বলে মনে হচ্ছিলো। বলতে গেলে এক দৌড়েই চললাম পেয়িং ওয়ার্ডটায়। ওয়ার্ডে ঢুকতেই আর আমার ইমিডিয়েট বড় ভাইটা আপাকে দেখে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। আমরা ওয়ার্ডের শেষ মাথায় এসে দেখলাম, সবার বড় ভাই বাবার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছে। ডাক্তার বাবার মুখটাও ঢেকে দিয়েছেন একটা চাঁদর দিয়ে। তার পর থেকে আমার বাবাকে ঘিরে জমেথাকা বাস্তবগুলো অতীত হওয়া শুরু করলো। আজ তাঁর মৃত্যুর এক দশক পর এসে মনে হচ্ছে, নানা দিক থেকে সফল হওয়ার চেষ্টা করা একটা ব্যার্থ মানুষ আমার বাবা। আর আমি কি আপনার সেই সন্তান? যে কিনা এখনো সফল হওয়ার স্বপ্নই দেখে যাচ্ছি কেবল?

Read More

2 মন্তব্য(গুলি):

এই সাইটের যে কোনও লেখা যে কেউ অনলাইনে ব্যবহার করতে পারবে। তবে লেখকের নাম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।

Blogger template Proudly Powered by Blogger. Arranged By: এতক্ষণে অরিন্দম