মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ভারত বর্ষের সিনেমার ইতিহাসে যে সকল মানুষের নাম আবশ্যিক উপস্থিত হয় তার মাঝে ঋত্বিক কুমার ঘটক এর নাম আসবেই। নিজের জীবনকে তিনি কখনোই নিজের বলে ভাবেন নি। ভেবেছেন মানুষের জীবন হিসেবে। তাই আদ্যোপান্ত একজন আপোষহীন মানুষ হিসেবে দিনকে দিন বেড়ে ওঠেছেন, বাড়িয়েছেন তাঁর প্রতি শিল্পের দায়। এই দায় কি একটা কথা বা একটা গল্প বা একটা সিনেমার দায়? না এই দায় সংস্কৃতির দায়। সংস্কৃতি এই দায়কে পোষণ করে। তার নিরন্তর বয়ে চলার মাঝেই তা বয়ে চলে। নইলে দিনকে দিন মানুষের বুকের ভেতর থেকে সংস্কৃতির প্রতি যে টান, যাকে আমরা ভালোবাসা বা প্রেম বলি তা হয়তো থাকতো না। অথচ শিল্পের প্রতি ভালোবাসার চেয়ে ঋত্বিকের বেশি ছিলো দায়। সেই দায় থাকার কারনেই সে বলতে পেরেছিলো, সিনেমা আমার কাছে মানুষের কাছে পৌঁছানোর একটা মাধ্যম। যেদিন মানুষের কাছে পৌছুতে এর চেয়ে ভালো কোনও মাধ্যম চলে আসবে, সেদিন সিনেমাকে লাথি মেরে আমি তার কাছে চলে যাবো। অথচ এই শিল্পই কিনা ঋত্বিক কে বিক্রি করতে ছাড়ে নাকড়ায় গন্ডায় তোলে নেয় তার দাম আর সেই শিল্প যদি হয় সিনেমা তবে তো বলতে হবে বাণিজ্যিকি করণের ষোলকলা পূর্ণ হইলো। এত কথা বলার কারণ, ঋত্বিকের জীবনের ৯৫ ভাগ তথ্য ও ঘটনা নিয়ে ঋত্বিকের সিনেমার নামেই নতুন করে সিনেমা নির্মাণ হয়, তাও আবার সব চরিত্র কাল্পনিক অনুপ্রেরণা মাত্র উল্লেখ করে। তখন আর বলার কিছু থাকে না। থাকবে কি করে, বাজার অর্থনীতির নিয়মই যে তা।

তার দেশেরই একজন লেখক, যে কিনা ফিল্ম বানানোর চেষ্টা-চরিত্র করেও হয়েছেন কথা সাহিত্যিক। সেই শাহযাদ ফেরদাউস তার এক উপন্যাসে লিখেছিলেন মুক্ত বাজার অর্থনীতির চূড়ান্ত রূপ কাকে বলে। কিভাবে বাজার আমাদের গ্রাস করে, ঢুকে যায় আমাদের অন্দরেরও অন্দরে। যেখানে কেবল একা আমি, সেখানেও বাজার বিষয়টি চলে আসে। শাহযাদের উপন্যাসে আমরা দেখেছিলাম একজন তার জীবন থেকে বিক্রয় করার মত আর কিছু না পেয়ে অতীত বিক্রয় করে দেয় চড়া দামে। তারপর সে বুঝতে শুরু করে সে আসলে তার বায়বীয় অতীতটা কি, আর এর প্রভাবটাই বা কোথায় গিয়ে পরে। যেমন রাতে ছোট ছেলে এসে জিজ্ঞাসা করে, বাবা অতীত কি? ছেলেকে বুঝানোর জন্য সে বলে, সকালে যে তোমার ক্ষুধা লেগেছিলো, তুমি খেয়েছিলে সেটা অতীত। তখন ছেলেটা বলে তুমি যে তোমার মায়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে, সেটাও কি তাহলে অতীত? তুমি কি তা বিক্রি করে দিয়েছো? সেই প্রশ্নের উত্তর তার আর কিছু বলার থাকে না। আর এভাবেই বুঝতে পারে সব কিছু পণ্য হয়ে গেলে মানুষের অন্তঃসার শূন্যতার কোনও মূল্য থাকে না। কমলেশ্বর মুখার্জীর পরিচালিত মেঘে ঢাকা তারা ছবিটাও তেমনি ঋত্বিক কুমার ঘটকের অন্তঃসার সব কিছু দিয়েই নির্মিত। আর তাই পরিচালক নতুন কোনও গল্প এখানে বলতে পারে নি। বলেছে ঋত্বিকেরই জীবন ও গল্প। তাও আবার কাল্পনিক মোড়কে।
কি আছে মেঘে ঢাকা তারায়? এই ছবির গল্প নীলকণ্ঠ বাগচী নামের একজন সংস্কৃতি কর্মীর। যিনি সংস্কৃতিকে মনে করতেন সমাজ বদলের হাতিয়ার। তাই শুরুতে গান, গান থেকে নাটক, নাটক থেকে সিনেমায় এসেছিলেন তিনি। পার্টির সদস্যদের তিনি বলেছিলেন, মানুষের কাছে পৌছানোর জন্য সিনেমার চেয়ে ভালো কোনও মাধ্যম তার কাছে এলে সে সিনেমাকে লাথি মেরে চলে যাবে। সেই মানুষটা এক সময় পার্টির কাছেও হয়ে পড়েছিলেন ব্রাত্য। জীবন, সমাজ ও সংসারে এই মানুষটি সারা জীবন তার কথা বলতে গিয়ে চারপাশের মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে মানুষের জন্যই হাহাকার করেছেন। আর এই সিনেমার গল্পই ছিলো এই জীবন। যা কিনা ঋত্বিক ঘটকেরই পূর্ণ জীবনের সংস্কৃতিকর্মী অংশটিই মূখ্য ছিলো। শিল্প শ্রমিক ঋত্বিকের এইসব জীবন নাটক কম বেশী সবাই জানে। তবে কখনোই পর্দায় অন্যের দ্বারা রূপান্তরিত হবে আর তা প্রদর্শণের আগে বলবে তা কাল্পনিক ও মিলে যাওয়া কাকতালীয় এটা বোধহয় এক ধরনের ভাড়ামি ছাড়া আর কিছু নয়।
ঋত্বিকের জীবন নিয়ে সিনেমা হচ্ছে জেনে ভালোই লেগেছিলো। ছবির ট্রেলার দেখে মুগ্ধও হয়েছিলাম। সেই মুগ্ধতা বাড়িয়ে দিয়েছিলো বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া ছবির রিভিউ। কিন্তু কোথাও দেখিনি ছবি সম্পর্কে এই গুরুতর অভিযোগ সম্পর্কে মুখ খুলতে। এসবও এক প্রকার বোঝাপড়ার বিষয়। যেমন জেনে আসছি, কাক কাকের মাংস খায় না। তেমনই এই ছবি সম্পর্কে বলেছেন সে দেশের মিডিয়া। যেই লোকটা এমনই দেশাল ছিলেন, যে দেশি মদে বুদ হয়ে থাকা মানুষটাকে বন্ধুরা জোর করে এক পেগ ভদকা খাইয়ে দিতে চাইলেও তাতে তার বিতৃষ্ণা হতো। সেই লোকটার জীবনটা মহৎ হয়ে উঠতে পারতো এই ছবির একটি মাত্র মিথ্যা না থাকলে। আর তা হলো ঐ এই ছবির সমস্ত চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক মন্তব্যে।

পরিচালক কমলেশ্বরের ইচ্ছার জগতে ঋত্বিক না হয় বিক্রি হয়েই গেলো, তা তো আর রুখতে পারা গেলো না। তাই বলে ছবিটা কি এনজয় করেছি কি না সে কথাও তো বলতেই হয়। হ্যা, ছবিটা বেশ হয়েছে মাইরি। এই ছবির প্রত্যেকটা অণুষঙ্গ যদি ঋত্বিক না হতো তবে তা পূর্ণতা পেতো বলেই মনে করি। রঙিন ছবির দুনিয়ায়ও সাদাকালো পর্দার ছবিতে দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফি তো লোভ লাগানোর মতোই। এর সাথে শাশ্বতর অভিনয়ও বেশ উপভোগ্য ছিলো। সম্ভবত এই ছবিতেই সবচে ভালো আর সবচে বেশী অভিনয় করার সুযোগ পেলেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। এর আগে তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্র মানে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলে মনে পড়ছে না। কিন্তু শাশ্বতর প্রসঙ্গ আসলেই মনে হয় এই রকম মোটকু একটা মানুষ কি করে ঋত্বিক ঘটকের চরিত্রে নির্বাচিত হলেন? এর প্রশ্নের উত্তর পেতে অবশ্য বেশী দেরি হয় না। কারণ, মঞ্চে আমরা যেসব অভিনয় পদ্ধতির কথা জেনেছিলাম তার মাঝে একটি পদ্ধতি ব্রেটল ব্রেখট এর। ব্রেখট বলতেন মঞ্চের অভিনয় যেহেতু পুরোপুরি বাস্তব নয়, তাই সেখানেও কিছু গল্পের সাথে অবাস্তব সম্পর্কযুক্ত বিষয় রাখতেই হবে। বিষয়টা অনেকটা এরকম, যে চিড়িয়াখানার গল্প বলা হলেও সেখানে হয়তো একটা সোফা থাকবে। যাতে বিষয়টি পুরোপুরি বাস্তবানুগ না হয়। এখানে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে পরিচালক এই পদ্ধতিই এপ্লাই করেছেন বলে বোধ করি। তবে শাশ্বত অভিনয় ভালো করেছেন। তার তুলনায় অনন্যা চ্যাটার্জির অভিনয় তেমন কোনও নজর কাড়ে নি। তবুও আমরা পুরো ১৫৫ মিনিট বসে ছিলাম পর্দার সামনে। কারণ, ঐ ঋত্বিক। ঐ ঋত্বিকের জন্যই উঠার উপায় ছিলো না। তবে শেষ দৃশ্যে এসেও প্রশ্ন থেকেই যায়। যেখানে একজন রিফিউজি মেয়ের সাথে মনের আনন্দে ঋত্বিক বেড়িয়ে পড়েছেন অজানা গন্তব্যে। আর সেই ছবিটাই ধীরে ধীরে রঙিন হয়ে যাচ্ছে। ঋত্বিক কি আসলেই এই রঙিন জীবনের দেখা পেয়েছিলেন? নাকি বরাবরই স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন একটা রঙিন সমাজের? যেই সমাজ তাকে কখনোই চিনতে, মূল্যায়ন করতে পারে নি। বরং আশার বদলে হতাশাই উপহার দিয়েছে। এত কিছুর পরও শ্রীমাণ ঋত্বিক কুমার ঘটক ভালোবেসে গেছেন মানুষকে। কারণ, তিনি জানতেন সব সময়ের সব কিছুই এই মানুষগুলোর জন্যই। আর মানুষই সব। বাকি সব মিথ্যা। 

অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহিরে

at মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৩  |  No comments

ভারত বর্ষের সিনেমার ইতিহাসে যে সকল মানুষের নাম আবশ্যিক উপস্থিত হয় তার মাঝে ঋত্বিক কুমার ঘটক এর নাম আসবেই। নিজের জীবনকে তিনি কখনোই নিজের বলে ভাবেন নি। ভেবেছেন মানুষের জীবন হিসেবে। তাই আদ্যোপান্ত একজন আপোষহীন মানুষ হিসেবে দিনকে দিন বেড়ে ওঠেছেন, বাড়িয়েছেন তাঁর প্রতি শিল্পের দায়। এই দায় কি একটা কথা বা একটা গল্প বা একটা সিনেমার দায়? না এই দায় সংস্কৃতির দায়। সংস্কৃতি এই দায়কে পোষণ করে। তার নিরন্তর বয়ে চলার মাঝেই তা বয়ে চলে। নইলে দিনকে দিন মানুষের বুকের ভেতর থেকে সংস্কৃতির প্রতি যে টান, যাকে আমরা ভালোবাসা বা প্রেম বলি তা হয়তো থাকতো না। অথচ শিল্পের প্রতি ভালোবাসার চেয়ে ঋত্বিকের বেশি ছিলো দায়। সেই দায় থাকার কারনেই সে বলতে পেরেছিলো, সিনেমা আমার কাছে মানুষের কাছে পৌঁছানোর একটা মাধ্যম। যেদিন মানুষের কাছে পৌছুতে এর চেয়ে ভালো কোনও মাধ্যম চলে আসবে, সেদিন সিনেমাকে লাথি মেরে আমি তার কাছে চলে যাবো। অথচ এই শিল্পই কিনা ঋত্বিক কে বিক্রি করতে ছাড়ে নাকড়ায় গন্ডায় তোলে নেয় তার দাম আর সেই শিল্প যদি হয় সিনেমা তবে তো বলতে হবে বাণিজ্যিকি করণের ষোলকলা পূর্ণ হইলো। এত কথা বলার কারণ, ঋত্বিকের জীবনের ৯৫ ভাগ তথ্য ও ঘটনা নিয়ে ঋত্বিকের সিনেমার নামেই নতুন করে সিনেমা নির্মাণ হয়, তাও আবার সব চরিত্র কাল্পনিক অনুপ্রেরণা মাত্র উল্লেখ করে। তখন আর বলার কিছু থাকে না। থাকবে কি করে, বাজার অর্থনীতির নিয়মই যে তা।

তার দেশেরই একজন লেখক, যে কিনা ফিল্ম বানানোর চেষ্টা-চরিত্র করেও হয়েছেন কথা সাহিত্যিক। সেই শাহযাদ ফেরদাউস তার এক উপন্যাসে লিখেছিলেন মুক্ত বাজার অর্থনীতির চূড়ান্ত রূপ কাকে বলে। কিভাবে বাজার আমাদের গ্রাস করে, ঢুকে যায় আমাদের অন্দরেরও অন্দরে। যেখানে কেবল একা আমি, সেখানেও বাজার বিষয়টি চলে আসে। শাহযাদের উপন্যাসে আমরা দেখেছিলাম একজন তার জীবন থেকে বিক্রয় করার মত আর কিছু না পেয়ে অতীত বিক্রয় করে দেয় চড়া দামে। তারপর সে বুঝতে শুরু করে সে আসলে তার বায়বীয় অতীতটা কি, আর এর প্রভাবটাই বা কোথায় গিয়ে পরে। যেমন রাতে ছোট ছেলে এসে জিজ্ঞাসা করে, বাবা অতীত কি? ছেলেকে বুঝানোর জন্য সে বলে, সকালে যে তোমার ক্ষুধা লেগেছিলো, তুমি খেয়েছিলে সেটা অতীত। তখন ছেলেটা বলে তুমি যে তোমার মায়ের কোলে শুয়ে গল্প শুনতে, সেটাও কি তাহলে অতীত? তুমি কি তা বিক্রি করে দিয়েছো? সেই প্রশ্নের উত্তর তার আর কিছু বলার থাকে না। আর এভাবেই বুঝতে পারে সব কিছু পণ্য হয়ে গেলে মানুষের অন্তঃসার শূন্যতার কোনও মূল্য থাকে না। কমলেশ্বর মুখার্জীর পরিচালিত মেঘে ঢাকা তারা ছবিটাও তেমনি ঋত্বিক কুমার ঘটকের অন্তঃসার সব কিছু দিয়েই নির্মিত। আর তাই পরিচালক নতুন কোনও গল্প এখানে বলতে পারে নি। বলেছে ঋত্বিকেরই জীবন ও গল্প। তাও আবার কাল্পনিক মোড়কে।
কি আছে মেঘে ঢাকা তারায়? এই ছবির গল্প নীলকণ্ঠ বাগচী নামের একজন সংস্কৃতি কর্মীর। যিনি সংস্কৃতিকে মনে করতেন সমাজ বদলের হাতিয়ার। তাই শুরুতে গান, গান থেকে নাটক, নাটক থেকে সিনেমায় এসেছিলেন তিনি। পার্টির সদস্যদের তিনি বলেছিলেন, মানুষের কাছে পৌছানোর জন্য সিনেমার চেয়ে ভালো কোনও মাধ্যম তার কাছে এলে সে সিনেমাকে লাথি মেরে চলে যাবে। সেই মানুষটা এক সময় পার্টির কাছেও হয়ে পড়েছিলেন ব্রাত্য। জীবন, সমাজ ও সংসারে এই মানুষটি সারা জীবন তার কথা বলতে গিয়ে চারপাশের মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে মানুষের জন্যই হাহাকার করেছেন। আর এই সিনেমার গল্পই ছিলো এই জীবন। যা কিনা ঋত্বিক ঘটকেরই পূর্ণ জীবনের সংস্কৃতিকর্মী অংশটিই মূখ্য ছিলো। শিল্প শ্রমিক ঋত্বিকের এইসব জীবন নাটক কম বেশী সবাই জানে। তবে কখনোই পর্দায় অন্যের দ্বারা রূপান্তরিত হবে আর তা প্রদর্শণের আগে বলবে তা কাল্পনিক ও মিলে যাওয়া কাকতালীয় এটা বোধহয় এক ধরনের ভাড়ামি ছাড়া আর কিছু নয়।
ঋত্বিকের জীবন নিয়ে সিনেমা হচ্ছে জেনে ভালোই লেগেছিলো। ছবির ট্রেলার দেখে মুগ্ধও হয়েছিলাম। সেই মুগ্ধতা বাড়িয়ে দিয়েছিলো বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া ছবির রিভিউ। কিন্তু কোথাও দেখিনি ছবি সম্পর্কে এই গুরুতর অভিযোগ সম্পর্কে মুখ খুলতে। এসবও এক প্রকার বোঝাপড়ার বিষয়। যেমন জেনে আসছি, কাক কাকের মাংস খায় না। তেমনই এই ছবি সম্পর্কে বলেছেন সে দেশের মিডিয়া। যেই লোকটা এমনই দেশাল ছিলেন, যে দেশি মদে বুদ হয়ে থাকা মানুষটাকে বন্ধুরা জোর করে এক পেগ ভদকা খাইয়ে দিতে চাইলেও তাতে তার বিতৃষ্ণা হতো। সেই লোকটার জীবনটা মহৎ হয়ে উঠতে পারতো এই ছবির একটি মাত্র মিথ্যা না থাকলে। আর তা হলো ঐ এই ছবির সমস্ত চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক মন্তব্যে।

পরিচালক কমলেশ্বরের ইচ্ছার জগতে ঋত্বিক না হয় বিক্রি হয়েই গেলো, তা তো আর রুখতে পারা গেলো না। তাই বলে ছবিটা কি এনজয় করেছি কি না সে কথাও তো বলতেই হয়। হ্যা, ছবিটা বেশ হয়েছে মাইরি। এই ছবির প্রত্যেকটা অণুষঙ্গ যদি ঋত্বিক না হতো তবে তা পূর্ণতা পেতো বলেই মনে করি। রঙিন ছবির দুনিয়ায়ও সাদাকালো পর্দার ছবিতে দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফি তো লোভ লাগানোর মতোই। এর সাথে শাশ্বতর অভিনয়ও বেশ উপভোগ্য ছিলো। সম্ভবত এই ছবিতেই সবচে ভালো আর সবচে বেশী অভিনয় করার সুযোগ পেলেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। এর আগে তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্র মানে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলে মনে পড়ছে না। কিন্তু শাশ্বতর প্রসঙ্গ আসলেই মনে হয় এই রকম মোটকু একটা মানুষ কি করে ঋত্বিক ঘটকের চরিত্রে নির্বাচিত হলেন? এর প্রশ্নের উত্তর পেতে অবশ্য বেশী দেরি হয় না। কারণ, মঞ্চে আমরা যেসব অভিনয় পদ্ধতির কথা জেনেছিলাম তার মাঝে একটি পদ্ধতি ব্রেটল ব্রেখট এর। ব্রেখট বলতেন মঞ্চের অভিনয় যেহেতু পুরোপুরি বাস্তব নয়, তাই সেখানেও কিছু গল্পের সাথে অবাস্তব সম্পর্কযুক্ত বিষয় রাখতেই হবে। বিষয়টা অনেকটা এরকম, যে চিড়িয়াখানার গল্প বলা হলেও সেখানে হয়তো একটা সোফা থাকবে। যাতে বিষয়টি পুরোপুরি বাস্তবানুগ না হয়। এখানে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে পরিচালক এই পদ্ধতিই এপ্লাই করেছেন বলে বোধ করি। তবে শাশ্বত অভিনয় ভালো করেছেন। তার তুলনায় অনন্যা চ্যাটার্জির অভিনয় তেমন কোনও নজর কাড়ে নি। তবুও আমরা পুরো ১৫৫ মিনিট বসে ছিলাম পর্দার সামনে। কারণ, ঐ ঋত্বিক। ঐ ঋত্বিকের জন্যই উঠার উপায় ছিলো না। তবে শেষ দৃশ্যে এসেও প্রশ্ন থেকেই যায়। যেখানে একজন রিফিউজি মেয়ের সাথে মনের আনন্দে ঋত্বিক বেড়িয়ে পড়েছেন অজানা গন্তব্যে। আর সেই ছবিটাই ধীরে ধীরে রঙিন হয়ে যাচ্ছে। ঋত্বিক কি আসলেই এই রঙিন জীবনের দেখা পেয়েছিলেন? নাকি বরাবরই স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন একটা রঙিন সমাজের? যেই সমাজ তাকে কখনোই চিনতে, মূল্যায়ন করতে পারে নি। বরং আশার বদলে হতাশাই উপহার দিয়েছে। এত কিছুর পরও শ্রীমাণ ঋত্বিক কুমার ঘটক ভালোবেসে গেছেন মানুষকে। কারণ, তিনি জানতেন সব সময়ের সব কিছুই এই মানুষগুলোর জন্যই। আর মানুষই সব। বাকি সব মিথ্যা। 

Read More

0 মন্তব্য(গুলি):

সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

পৃথিবীর ইতিহাসে এত বেশী মিশ্র ভাবনা-সংস্কৃতি আর চারিত্রের সংমিশ্রণ নিয়ে আমরা বেড়ে ওঠছি যে, ব্যাতিক্রম বাদে সবাই আমরা নানা ক্ষেত্রে সংকীর্ণতার চরম পরিচয় দিয়ে থাকি। আমাদের নানা সংকীর্ণতার মধ্যে আমাদের সামনে মানুষের যে সংকীর্ণ পরিচয়টা সবচে বেশী ব্যাথিত করে তা হলো মানুষ সত্যটা বলে না। কেবল যে নিজের স্বার্থের জন্য তা নয়, কিছুটা ঈর্ষাকাতর, কিছুটা অযোগ্যতা, কিছুটা লোভ, কিছুটা ব্যার্থতা থেকেও মানুষ এই কাজ করে। আর তার প্রভাব পরে সংস্কৃতিতে। এর সবচে বড় উদাহরণ জীবনানন্দ দাশের সাথে রজনীকান্ত দাশ-দের আচরণ। এখানে অবশ্য একটি বিষয় একটু বেশীই কাজ করে, তা হলো অযোগ্যতা। বিষয়টা এমন দাঁড়ায় যে, আমি অধম তুমি উত্তম হইবে কেন? এমন বিষয় নিয়ে আজ (রোববার) সন্ধ্যায় কথা হচ্ছিলো একজনের সাথে। তিনি বলছিলেন, সমসাময়িকদের থেকে ইচ্ছাকৃত দূরে থাকি। কারণ তারা কখনোই সৎ নয়, সত্য কে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে তারা আগ্রহী নয়। এই মুখোশে ভর্তি সময়ে তাই সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে যেমন বলাল মানুষের অভাব তেমন, ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলাও অনেক কঠিন। তবে আমি আজ একটি ভালোর কথাই বলবো। আর তা হলো কামার আহমেদ সাইমন ও সারা আফরীন নির্মিত ছবি শুনতে কি পাও এর কথা।
বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়, তবে যে কথাটা সবার শেষে অথবা সবার শুরুতে বলতে পারি তা হলো ছবিটা অনবদ্য। শুরুতেই একটু ছবির চারপাশ ঘুরে আসি। আমরা বই পড়ি, গান শুনি, ছবি দেখি, চিত্রকলা দেখি কি জন্যে? প্রত্যেকটা মহৎ শিল্পই তো আমাদের নতুন একটি জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় বা ঐ জগতে ভ্রমণ করিয়ে নিয়ে আসে। একটা চমৎকার বই পড়ার পর, বইয়ে লেখা চরিত্রগুলো যেমন আমাদের চারপাশে বিরাজ করে, তেমন একটা ভালো ছবির চরিত্রগুলোও কি তেমন করে না? আমার তেমনই হয়। আমি বুদ হয়ে থাকি মুগ্ধতা মাখা সেইসব বই পড়ে অথবা ছবি দেখে। আর বাংলাদেশের সিনেমা দেখতে গিয়ে নানা কারণে প্রত্যাশা শূন্য রেখে দেখতে হয়। তবে কিছুটা প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে। নয়তো এই প্রাপ্তি অপ্রাপ্তিতে রূপান্তর হয় বড় করুণ আকারে। এইসব প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির মাঝে হঠাৎ করে জ্বলে ওঠে সূর্য। ঝলসে যেতে চায় চোখ। তবে রেহাই মিলে, কারণ চোখগুলো এতদিনে আর টলমলে নেই।
কামার আহমেদ সাইমন ও সারা আফরীন তাঁদের ছবি শুনতে কি পাও এর জন্য একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। পৃথিবীর সবচে পুরনো চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনি হয়েছে এই ছবি দিয়ে (খবর ), প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউরোপের অন্যতম প্রামান্য উৎসবসিনেমা দ্যু রিলেমূল আর্ন্তজাতিক প্রতিযোগিতায়শ্রেষ্ঠ ছবি পুরষ্কার গ্রা প্রী পেয়েছে এই ছবি। এমন সংবাদ আমরা প্রতিবারই জেনেছি সংবাদ মাধ্যমে।  এমন সংবাদ পেলে কি ছবি দেখার আগ্রহ বাড়ে না? তো আমার বা আমাদেরো এমন আগ্রহ বেড়েছে। কিন্তু ছবি দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে না। কারণ, ছবিটির শো হচ্ছে না কোথাও। এর মাঝে একদিন খবরের কাগজে দেখলাম ছবির প্রিমিয়ার হয়ে গেছে পাবলিক লাইব্রেরিতে। প্রিমিয়ার হওয়ার আগে খবর পাই নি, খবর পাইলাম প্রিমিয়ারের পর। তাই আরো কিছুটা রাগ হলো। কদিন পর দেখলাম ছবিটার একটি শো হচ্ছে ঢাবির টিএসসিসে ডিইউএফএস এর আয়োজনে। খবরটা এমন সময় হাতে পাইলাম যে ততক্ষণে অফিস শিডিউল বদলানোর সুযোগ নেই। আবারো ক্ষেদ জমলো মনে। আর এই ক্ষেদ মিটানোর সুযোগ হলো সম্প্রতি নির্মাতার নিজস্ব আয়োজনে ছবি দেখার সুযোগ পেয়ে। সত্যি বলছি, ছবি দেখার পর ছবির নির্মাতা বা সংশ্লিষ্ট সকল মানুষের প্রতি আর কোনও অভিযোগ নেই। সংবাদ মাধ্যমে এই ছবি সম্পর্কে জেনেছিলাম এটি একটি প্রামাণ্যচিত্র। কিন্তু ছবি দেখার পর এই শব্দটির ব্যবহারকে আমার মনে হয়েছে ছবিটির অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এই ছবিটিকে আমরা প্রামাণ্যচিত্র না বলে যদি শুধু একটি সিনেমা বলি তবে তা পূর্ণতা পাবে। এমন কথাই পরিচালক ছবি শুরু হওয়ার আগে বলেছিলেন আমাদের। বলেছিলেন, ছবি দেখার সময় আপনারা ছবিটি প্রামাণ্যচিত্র না ফিচার ফিল্ম তা মাথায় না রেখে দেখবেন, দেখার পর যা মনে হয় বলবেন। হ্যা, তাই করেছিলাম। আর এখন বলতে হচ্ছে প্রামাণ্যচিত্রের যে তথাকথিত ফর্ম আমরা আগে দেখেছি, তা এখানে নেই। আবার ফিকশনেও যা দেখি তাও এখানে নেই। এখানে তবে কি আছে? এখানে আছে জীবন ও বাস্তবতা। আছে সংগ্রাম, প্রেম, দ্বন্দ্ব, রাজনীতি, অর্থনীতি, স্বপ্ন, স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প। এবার বলুন, এত কিছু যদি কোনও কিছুতে থাকে তবে তাকে কি আপনি প্রামাণ্যচিত্র বলবেন? এইসব তো পরিকল্পিত চিত্রনাট্যের সাজানো ছবিতে থাকে। হ্যা, এই ছবির চিত্রনাট্যও সাজানো। তবে তা বাস্তবকে দেখে, সেখান থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন সাইমন। আর এইসব খুঁজে খুঁজে বের করে তাঁর ছবির মালা গেথেছেন। এই কারণে ছবি দেখার সময় ভুলেই গিয়েছিলাম প্রামাণ্যচিত্র না ফিকশন দেখছি।
ছবির গল্পের মূল চরিত্র ৩ জন সংগ্রামী। তারা হলেন ২০০৯ সালের ২৫ মে বাংলাদেশে আঘাত হানা আইলায় আক্রান্ত একটি পরিবার। পরিবারটির প্রধান পুরুষ চরিত্র সৌমেন, প্রধান নারী চরিত্র রাখী ও তাদের চার বছর বয়স্ক একমাত্র সন্তান রাহুল। বাড়িঘর হারিয়ে আরো হাজার হাজার নারী পুরুষের সাথে যখন তারা পথে আশ্রয় নেয়। ছবির সমগ্রতা জুড়ে আছে এই তিনজন। এই তিনজনের জীবন ও তাদের চারপাশের মাধ্যমে উঠে এসেছে আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান,রাষ্ট্র ও তার অগোছালো জীবনের ছবি।নব্বই মিনিটের এই ছবি পর্দায় শেষ হলেও কিন্তু শেষ হয় না তাদের প্রতিদিনকার সংগ্রামের গল্প। কারণ, মানুষের সংগ্রাম যে শেষ হয় না কখনো,সে কথাও বলা আছে এই ছবিতে। 
শুরুতে যে কথা বলতে চেয়েছিলাম। তা হলো আমাদের সংকীর্ণতার সুযোগে জীবনানন্দ তার কবিতার খাতা ট্রাঙ্কে ভরে রাখে। আমরা এমন সংকীর্ণতাকে নিয়েই বেড়ে ওঠি, তাই আমাদের চারপাশে জীবনানন্দ-রা বারবার আসে না। তেমনি আমাদের দেশের সিনেমার রঙিন মানুষদের জগৎটা আরো লোভের, আরো রূঢ়। তাদের মুখ থেকে অন্যের ভালোটা বের হয় না। যতটা না বলে আম পাবলিক। আমাদের এইসব আশা-হতাশা নিয়েই যেহেতু বাঁচতে হবে, দেখতে হবে কিভাবে একটা শিল্পের ফুল গোবরে পদ্ম হয়ে ফুটে। তাই আমরাও প্রস্তুত হয়েই থাকি। সৌমেন, রাখি আর রাহুলরা যেমন প্রতিদিন সংগ্রাম করে ঝড়-তুফানের সঙ্গে পাশাপাশি আমরাও মুখে কুলুপ আটা সভ্যতার চারপাশেই বেড়ে ওঠি ফুলকে ফুল আর ময়লা আবর্জনাকে নোংরা বলে জানান দিতে।

বিষাদের কাঁচপোকাদের দখলে থেকে থেকে তো আমার আপনার চিন্তায় কিছুটা শ্যাওলা জমে আছে। শুনতে কি পাও- ছবি দেখার পর আপনার আমার মগজের সেই শ্যাওলা কাটিয়ে তুলবে বলে আশা করি। চাই এই ছবি দেখুক কোষ্ঠ-কাঠিন্যে ভরা বুদ্ধিজীবী, দেখে কিছু বলতে না পেরে মুখ লুকিয়ে প্রদর্শণী থেকে বেরিয়ে যাক। আর আমাদের পথে প্রান্তরের কোটি জনতা ছবির মানুষ হয়ে ওঠুক, দেখুক তাদের জীবন আমাদের চলচ্চিত্রে। কারণ, মনে করি যতদিন সাধারণ মানুষ চলচ্চিত্রের চরিত্র হয়ে উঠতে না পারে ততদিন আমাদের সিনেমা বদলাবে না। জয় হোক সিনেমার, জয় হোক সাধারণ মানুষের। 




শুনতে কি পাও: আমার সিনেমা দর্শন

at সোমবার, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৩  |  2 comments

পৃথিবীর ইতিহাসে এত বেশী মিশ্র ভাবনা-সংস্কৃতি আর চারিত্রের সংমিশ্রণ নিয়ে আমরা বেড়ে ওঠছি যে, ব্যাতিক্রম বাদে সবাই আমরা নানা ক্ষেত্রে সংকীর্ণতার চরম পরিচয় দিয়ে থাকি। আমাদের নানা সংকীর্ণতার মধ্যে আমাদের সামনে মানুষের যে সংকীর্ণ পরিচয়টা সবচে বেশী ব্যাথিত করে তা হলো মানুষ সত্যটা বলে না। কেবল যে নিজের স্বার্থের জন্য তা নয়, কিছুটা ঈর্ষাকাতর, কিছুটা অযোগ্যতা, কিছুটা লোভ, কিছুটা ব্যার্থতা থেকেও মানুষ এই কাজ করে। আর তার প্রভাব পরে সংস্কৃতিতে। এর সবচে বড় উদাহরণ জীবনানন্দ দাশের সাথে রজনীকান্ত দাশ-দের আচরণ। এখানে অবশ্য একটি বিষয় একটু বেশীই কাজ করে, তা হলো অযোগ্যতা। বিষয়টা এমন দাঁড়ায় যে, আমি অধম তুমি উত্তম হইবে কেন? এমন বিষয় নিয়ে আজ (রোববার) সন্ধ্যায় কথা হচ্ছিলো একজনের সাথে। তিনি বলছিলেন, সমসাময়িকদের থেকে ইচ্ছাকৃত দূরে থাকি। কারণ তারা কখনোই সৎ নয়, সত্য কে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে তারা আগ্রহী নয়। এই মুখোশে ভর্তি সময়ে তাই সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে যেমন বলাল মানুষের অভাব তেমন, ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলাও অনেক কঠিন। তবে আমি আজ একটি ভালোর কথাই বলবো। আর তা হলো কামার আহমেদ সাইমন ও সারা আফরীন নির্মিত ছবি শুনতে কি পাও এর কথা।
বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়, তবে যে কথাটা সবার শেষে অথবা সবার শুরুতে বলতে পারি তা হলো ছবিটা অনবদ্য। শুরুতেই একটু ছবির চারপাশ ঘুরে আসি। আমরা বই পড়ি, গান শুনি, ছবি দেখি, চিত্রকলা দেখি কি জন্যে? প্রত্যেকটা মহৎ শিল্পই তো আমাদের নতুন একটি জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় বা ঐ জগতে ভ্রমণ করিয়ে নিয়ে আসে। একটা চমৎকার বই পড়ার পর, বইয়ে লেখা চরিত্রগুলো যেমন আমাদের চারপাশে বিরাজ করে, তেমন একটা ভালো ছবির চরিত্রগুলোও কি তেমন করে না? আমার তেমনই হয়। আমি বুদ হয়ে থাকি মুগ্ধতা মাখা সেইসব বই পড়ে অথবা ছবি দেখে। আর বাংলাদেশের সিনেমা দেখতে গিয়ে নানা কারণে প্রত্যাশা শূন্য রেখে দেখতে হয়। তবে কিছুটা প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে। নয়তো এই প্রাপ্তি অপ্রাপ্তিতে রূপান্তর হয় বড় করুণ আকারে। এইসব প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির মাঝে হঠাৎ করে জ্বলে ওঠে সূর্য। ঝলসে যেতে চায় চোখ। তবে রেহাই মিলে, কারণ চোখগুলো এতদিনে আর টলমলে নেই।
কামার আহমেদ সাইমন ও সারা আফরীন তাঁদের ছবি শুনতে কি পাও এর জন্য একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। পৃথিবীর সবচে পুরনো চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনি হয়েছে এই ছবি দিয়ে (খবর ), প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউরোপের অন্যতম প্রামান্য উৎসবসিনেমা দ্যু রিলেমূল আর্ন্তজাতিক প্রতিযোগিতায়শ্রেষ্ঠ ছবি পুরষ্কার গ্রা প্রী পেয়েছে এই ছবি। এমন সংবাদ আমরা প্রতিবারই জেনেছি সংবাদ মাধ্যমে।  এমন সংবাদ পেলে কি ছবি দেখার আগ্রহ বাড়ে না? তো আমার বা আমাদেরো এমন আগ্রহ বেড়েছে। কিন্তু ছবি দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে না। কারণ, ছবিটির শো হচ্ছে না কোথাও। এর মাঝে একদিন খবরের কাগজে দেখলাম ছবির প্রিমিয়ার হয়ে গেছে পাবলিক লাইব্রেরিতে। প্রিমিয়ার হওয়ার আগে খবর পাই নি, খবর পাইলাম প্রিমিয়ারের পর। তাই আরো কিছুটা রাগ হলো। কদিন পর দেখলাম ছবিটার একটি শো হচ্ছে ঢাবির টিএসসিসে ডিইউএফএস এর আয়োজনে। খবরটা এমন সময় হাতে পাইলাম যে ততক্ষণে অফিস শিডিউল বদলানোর সুযোগ নেই। আবারো ক্ষেদ জমলো মনে। আর এই ক্ষেদ মিটানোর সুযোগ হলো সম্প্রতি নির্মাতার নিজস্ব আয়োজনে ছবি দেখার সুযোগ পেয়ে। সত্যি বলছি, ছবি দেখার পর ছবির নির্মাতা বা সংশ্লিষ্ট সকল মানুষের প্রতি আর কোনও অভিযোগ নেই। সংবাদ মাধ্যমে এই ছবি সম্পর্কে জেনেছিলাম এটি একটি প্রামাণ্যচিত্র। কিন্তু ছবি দেখার পর এই শব্দটির ব্যবহারকে আমার মনে হয়েছে ছবিটির অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এই ছবিটিকে আমরা প্রামাণ্যচিত্র না বলে যদি শুধু একটি সিনেমা বলি তবে তা পূর্ণতা পাবে। এমন কথাই পরিচালক ছবি শুরু হওয়ার আগে বলেছিলেন আমাদের। বলেছিলেন, ছবি দেখার সময় আপনারা ছবিটি প্রামাণ্যচিত্র না ফিচার ফিল্ম তা মাথায় না রেখে দেখবেন, দেখার পর যা মনে হয় বলবেন। হ্যা, তাই করেছিলাম। আর এখন বলতে হচ্ছে প্রামাণ্যচিত্রের যে তথাকথিত ফর্ম আমরা আগে দেখেছি, তা এখানে নেই। আবার ফিকশনেও যা দেখি তাও এখানে নেই। এখানে তবে কি আছে? এখানে আছে জীবন ও বাস্তবতা। আছে সংগ্রাম, প্রেম, দ্বন্দ্ব, রাজনীতি, অর্থনীতি, স্বপ্ন, স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প। এবার বলুন, এত কিছু যদি কোনও কিছুতে থাকে তবে তাকে কি আপনি প্রামাণ্যচিত্র বলবেন? এইসব তো পরিকল্পিত চিত্রনাট্যের সাজানো ছবিতে থাকে। হ্যা, এই ছবির চিত্রনাট্যও সাজানো। তবে তা বাস্তবকে দেখে, সেখান থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন সাইমন। আর এইসব খুঁজে খুঁজে বের করে তাঁর ছবির মালা গেথেছেন। এই কারণে ছবি দেখার সময় ভুলেই গিয়েছিলাম প্রামাণ্যচিত্র না ফিকশন দেখছি।
ছবির গল্পের মূল চরিত্র ৩ জন সংগ্রামী। তারা হলেন ২০০৯ সালের ২৫ মে বাংলাদেশে আঘাত হানা আইলায় আক্রান্ত একটি পরিবার। পরিবারটির প্রধান পুরুষ চরিত্র সৌমেন, প্রধান নারী চরিত্র রাখী ও তাদের চার বছর বয়স্ক একমাত্র সন্তান রাহুল। বাড়িঘর হারিয়ে আরো হাজার হাজার নারী পুরুষের সাথে যখন তারা পথে আশ্রয় নেয়। ছবির সমগ্রতা জুড়ে আছে এই তিনজন। এই তিনজনের জীবন ও তাদের চারপাশের মাধ্যমে উঠে এসেছে আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান,রাষ্ট্র ও তার অগোছালো জীবনের ছবি।নব্বই মিনিটের এই ছবি পর্দায় শেষ হলেও কিন্তু শেষ হয় না তাদের প্রতিদিনকার সংগ্রামের গল্প। কারণ, মানুষের সংগ্রাম যে শেষ হয় না কখনো,সে কথাও বলা আছে এই ছবিতে। 
শুরুতে যে কথা বলতে চেয়েছিলাম। তা হলো আমাদের সংকীর্ণতার সুযোগে জীবনানন্দ তার কবিতার খাতা ট্রাঙ্কে ভরে রাখে। আমরা এমন সংকীর্ণতাকে নিয়েই বেড়ে ওঠি, তাই আমাদের চারপাশে জীবনানন্দ-রা বারবার আসে না। তেমনি আমাদের দেশের সিনেমার রঙিন মানুষদের জগৎটা আরো লোভের, আরো রূঢ়। তাদের মুখ থেকে অন্যের ভালোটা বের হয় না। যতটা না বলে আম পাবলিক। আমাদের এইসব আশা-হতাশা নিয়েই যেহেতু বাঁচতে হবে, দেখতে হবে কিভাবে একটা শিল্পের ফুল গোবরে পদ্ম হয়ে ফুটে। তাই আমরাও প্রস্তুত হয়েই থাকি। সৌমেন, রাখি আর রাহুলরা যেমন প্রতিদিন সংগ্রাম করে ঝড়-তুফানের সঙ্গে পাশাপাশি আমরাও মুখে কুলুপ আটা সভ্যতার চারপাশেই বেড়ে ওঠি ফুলকে ফুল আর ময়লা আবর্জনাকে নোংরা বলে জানান দিতে।

বিষাদের কাঁচপোকাদের দখলে থেকে থেকে তো আমার আপনার চিন্তায় কিছুটা শ্যাওলা জমে আছে। শুনতে কি পাও- ছবি দেখার পর আপনার আমার মগজের সেই শ্যাওলা কাটিয়ে তুলবে বলে আশা করি। চাই এই ছবি দেখুক কোষ্ঠ-কাঠিন্যে ভরা বুদ্ধিজীবী, দেখে কিছু বলতে না পেরে মুখ লুকিয়ে প্রদর্শণী থেকে বেরিয়ে যাক। আর আমাদের পথে প্রান্তরের কোটি জনতা ছবির মানুষ হয়ে ওঠুক, দেখুক তাদের জীবন আমাদের চলচ্চিত্রে। কারণ, মনে করি যতদিন সাধারণ মানুষ চলচ্চিত্রের চরিত্র হয়ে উঠতে না পারে ততদিন আমাদের সিনেমা বদলাবে না। জয় হোক সিনেমার, জয় হোক সাধারণ মানুষের। 




Read More

2 মন্তব্য(গুলি):

এই সাইটের যে কোনও লেখা যে কেউ অনলাইনে ব্যবহার করতে পারবে। তবে লেখকের নাম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।

Blogger template Proudly Powered by Blogger. Arranged By: এতক্ষণে অরিন্দম