আজ বন্ধু
দিবসকে সামনে রেখে বন্ধুরা তাদের ওয়াল ভরে দিচ্ছে বন্ধুত্বের স্মৃতি রোমন্থন করে।
স্মৃতি রোমন্থন আমি খুব একটা পছন্দ করি না। যে সকল
বন্ধুদের আমি মিস করি, তাদের কাছে রাখার চেষ্টা করি।
ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে বলে আশে পাশে এনে রাখার চেষ্টা করি যাতে তার সাথে চাইলেই দেখা করা
সম্ভব হয়। কিন্তু চাইলেই কি আর সবাইকে কাছে আনা যায়? সবাইকে যেমন কাছে এনে রাখা
যায় না তেমন চাইলেও তার কাছে যাওয়া যায় না। তেমন এক বন্ধুর কথাই আজ সবচে’ বেশী
মনে পড়ছে। তার নাম শওকত হোসেন।
শওকতের সাথে আমার পরিচয়
হয়েছিলো ১৯৯৮ সালে যখন বাড়ি ছেড়ে প্রথম বাড়ির বাইরে পড়তে বের হলাম তখন। আমি যে প্রতিষ্ঠানে
(কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ময়মনসিংহে) ক্লাস নাইনে গিয়ে ভর্তি হই, সেখানে সেও এসে
ভর্তি হয়েছিলো। দুই জনেই অস্থায়ী ছাত্র হওয়ায় আমরা ক্যাম্পাসের হোস্টেলে উঠেছিলাম।
তার রুম নং ছিলো ২১৪। আর আমার ২১১। ক্যাম্পাসে আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই ছিলো আমার অভিভাবক।
তাই আমাকে চোখে চোখে রাখতো যেনো আমি হোস্টেল জীবনের স্বাধীনতা পেয়ে বখে যাওয়া ছেলে
না হই। কিন্তু শওকতের তো তেমন কেউ ছিলো না। তার গ্রামের বাড়ি ছিলো জামালপুর জেলার ইসলামপুর
থানায়। পরে আমি একাধিকবার তার সুত্রে ইসলামপুর গিয়েছি।
প্রকৃত অর্থে আমার সাথে
ফার্স্ট ইয়ারে (ক্লাস নাইনকে সেখানে তাই বলা হতো) সখ্যতা খুব একটা জমেনি। জমেছিলো ক্লাস
টেন এ এসে। ঐ সময় আমাদের উড়নচণ্ডি জীবন শুরু হয়। তার ডিপার্টমেন্ট ছিলো অটোমোবাইল।
আমার ইলেকট্রিক্যাল। আমাগো সাথে ছিলো আমার ডিপার্টমেন্টের সুজন চন্দ্র দাশ। তার সাথে
এখনো আমার যোগাযোগ আছে। আর ছিলো তার ডিপার্টম্যান্টের মামুন। ভৈরব, কিশোরগঞ্জের। আমরা
চারজন মিলে ক্যাম্পাসের হেন কোনও অপকর্ম নাই করি নাই।
হোস্টেলের পুকুর থেকে মাছ
চুরি, হোস্টেলের নারিকেল গাছ থেকে ডাব চুরি আর কলার বাগান থেকে কলার ছড়ি চুরি করা আমাদের
অভ্যাসে পরিণত হয়েছিলো। মনে আছে একবার আমরা হোস্টেলের চারপাশের প্রায় সতেরোটা নারকেল
গাছ থেকে প্রায় শতাধিক ডাব পেরেছিলাম। আমরা চারজন খেয়ে শেষ করতে না পেরে শেষে এটা দিয়ে
ঘর মুছেছিলাম। অবশ্য কিছু কিছু অন্য ছেলেদেরও দিয়েছিলাম। তবে কেবল যাদের সাথে আমাদের
সম্পর্ক ভালো তাদেরকেই কেবল।
শওকত নিজেকে সৈকত বলতো।আমরা
ময়মনসিংহ শহরের সব সিনেমাহলগুলোতে সিনেমা দেখতাম। সিনেমা শুরু হতো রাত ৯.৩০ মিনিটে।
শেষ হৈতো বারোটা ৩০ এ। হোস্টেলে আসতে আসতে ১.৩০টা বেজে যেতো। দশটার পর হোস্টেলে ঢুকার
মেইন গেইট বন্ধ করে দিতো হোস্টেল সুপার। আর বিকল্প পদ্ধতিতে হোস্টেলে ঢুকার পথ খুঁজে
বের করছিলো সৈকতই। চারজন এক সাথে রিকশায় উঠতাম। সৈকত আর আমি রিকশার উপরিভাগে। ক্লাস
শেষে শহরের ঐ অঞ্চলটা মানে মাসকান্দা এলাকাটা এখনকার মতো তখনও এত শহুরে হয়ে না উঠায়
আমরা গ্রামে বেড় হইতাম ঘুরতে। প্রতিদিন এক সময় আমরা সিদ্ধান্ত নেই ময়মনসিংহ শহরের সব
রাস্তাগুলো আমরা পায়ে হেটে ঘুরবো। মূলত: চিনে নেওয়ার লক্ষ্য থেকেই এই সিদ্ধান্ত। আমরা
শুরু করেছিলাম। কিন্তু শেষ করতে পারিনি।
সৈকতের মার্শাল আর্টের
খুব শখ ছিলো। তার ওয়ারড্রবে সব সময়ই একটা চেইনস্টিক থাকতো। সে সপ্তাহে দুইদিন ক্যাম্পাসে
মার্শাল আর্টের ক্লাস হৈতো ঐখানে ভর্তি হইলো। কিছুদিন পরে শুনলাম তার মার্শাল আর্টের
পরীক্ষা।সে ইয়েলো বেল্ট থেকে না গ্রীন, না গ্রীন থেকে ইয়েলো হয় মনে নাই তেমন একটা বেল্ট
অর্জন করলো। আমার তারে ঈর্ষা হৈতো। কিন্তু কিছু কইতে পারতাম না। আমাদের হোস্টেলগুলোর
রুম গুলোতে সিলিং ফ্যান লাগানোর ব্যবস্থা ছিলো না। গরম পরলে আমরা কাথা বালিশ নিয়ে তিনতলা
হোস্টেলের ছাদে চলে যাইতাম। এই বুদ্ধিও সৈকতের আবিষ্কার। একদিন আমরা প্রায় সতেরো আঠারো
জন অসম্ভব গরমে সিদ্ধ হয়ে ঘুমানোর জন্য চাদর আর বালিশ নিয়ে ছাদে ঘুমাইতে যাই। শেষ রাত্রীতে
বৃষ্টি আমাদের অর্ধেক ভিজিয়ে দেয়। সেইসব স্মৃতি হারিয়ে যাবে এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবার
সাথে সাথেই। তখন তা এতটা আপন করে ভাবিই নি। তারপরও একটা নোটবুকে অনেক বন্ধুরই বাড়ির
ঠিকানা রাখা হয়েছিলো। সেই নোটবুক কবে যে কোথায় হারিয়েগেছে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর মতো।
সেই ৯৮/৯৯ সনে মোবাইল ফোন বিষয়টা আমাদের সবারকাছেই প্রায় অপরিচিত ছিলো। কারণ আমাদের
আসে পাশে আমরা কারও কাছে দেখিনি বস্তুটাকে। তাই যোগাযোগটা সহজ হয়নি আমাদের।
এসএসসির পরও সৈকতের সাথে
আমার যোগাযোগ হয়েছিলো, আমার বাড়িতে টিএন্ডটি ফোনের বদৌলতে সে আমাকে ফোন করতে পারতো।
আর চিঠি লিখতো সে, আমিও জবাব দিতাম। শেষবার তার বাড়ি যখন যাই তখন তুমুল বর্ষা। ইসলামপুর
স্টেশনে নেমে প্লাটফরম অতিক্রম করে সোজা বাজারে ঢুকে পরা যায়। কিন্তু আমি স্টেশনের
গেট দিতে বেড় হতে গিয়ে অনেক পথ ঘুরে তারপর তাদের বাড়ি হাজির হয়েছিলাম। তখন সে এইচএসসি
পরীক্ষা দেয়। আর কি যেনো একটা রোগ তার ঠিকঠাক মতো বলেনি। হাসপাতাল পার হয়ে তাদের বাড়িতে
সেবারই আমার শেষ যাত্রা। তার পর তার সাথে আমার আর যোগাযোগ হয় নি। এইচএসসির রেজাল্ট
ভালো করতে না পারায় আমি কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারিনি। তাই অনার্স পড়তে আমাকে
ভর্তি হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি পড়াশোনা, রাজনীতি, কবিতা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে
ব্যাপক ব্যস্ত হয়ে পরি। তার খোঁজ নিতে পারিনি। ভুল করেছি বন্ধু। পারলে এই ভুল আর কারো
সাথে কারবো না। অনার্স পরীক্ষা দিয়ে আমি কাজের খোঁজে ঢাকা চলে আসি। শুরু হয় নতুন ব্যস্ততা।
এক সময় মাস্টার্স পরীক্ষার জন্য আবার ময়মনসিংহে যাই। তার আগে থেকেই সৈকতের ব্যাপারে
কথা হৈতো। কোনও খোঁজ রাখতে পারিনি আমরা। নিজেরা কেবল দুঃখপ্রকাশই করি।
মাস্টার্স পরীক্ষার জন্য
যখন ময়মনসিংহ গেলাম হঠাৎ এক সপ্তাহ পরীক্ষা পিছিয়ে গেলো। আমার মনে হলো আমি এই সুযোগে
বন্ধুটার খোঁজ নিয়ে আসি। একদিন সন্ধ্যায় জামালপুর বাহাদুরাবাদঘাট মুখি ট্রেনের টিকিট
করে বসি।পরদিন সকাল ১০টায় ট্রেন। আমার ভেতরে উত্তেজনা। বন্ধুর খোঁজ নিতে যাচ্ছি। ট্রেন
গিয়ে থামে ইসলামপুর স্টেশনে। আমি বন্ধুর বাবার হোমিওপ্যাথী ওষুধের দোকান খুঁজি। ঐখানে
নতুন হোমিওপ্যাথীর দোকান খুঁজে পাই। জিজ্ঞেস করি এখানে বাহাদুর হোমিও হল ছিলো না? ঐ
লোক কিছুটা বিরক্তিকর চোখে আমার দিকে তাকায়। বলে কোত্থেকে আসছেন? বলি ময়মনসিংহ। তারা
তো নাই- জবাব দেয়। শোনায় অন্য কাহিনী। সে আমার বন্ধুর না। সে আমার বন্ধুর বাবার। সে
গল্প এখানে না বলি। আরও বিস্তারিত খোঁজ নিতে গিয়ে তার ভাইয়ের ইলেকট্রিকের দোকান আবিষ্কার
করি বাজারেই। তার ভাই শহরে নাই। চাকরি করে বাহাদুরাবাদঘাট পৌরসভায়। তার জন্য অপেক্ষা
করি। তিনি আসেন। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে তিনি এসেই ঠান্ডা পানিয় আনান, আর আনান বিস্কিট।
আমি প্রচণ্ড ক্ষুধার্থ। কিন্তু তারচেয়ে বেশী ক্ষুধার্থ আমি বন্ধুর খবর জানার জন্য।
তার কাছ থেকে জানলাম বন্ধু আমার আজ থেকে ৬ বছর পূর্বে দুটো কিডনী ড্যামেজ হয়ে মারা
গেছে। কত সহজেই বলে ফেললাম। ফেরার সময় আমার চোখে জল এসেছিলো কিনা মনে নেই। তবে ট্রেনে
করে আসার সময় হয়তো কিছুটা এসেছিলো। সামনের সীটের বৃদ্ধ যাত্রীটি আমার চোখের জল দেখে
হয়তো আশ্চর্য হয়েছিলো। আমি শুধু মনে মনে বলেছি, বন্ধু তোকে এভাবে হারাতে চাই নি আমি।
আমি চাই তুই আমার মাঝ দিয়ে বেঁচে থাক। বেঁচে থাক তুই।
0 মন্তব্য(গুলি):