সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

শুনতে কি পাও: আমার সিনেমা দর্শন

at সোমবার, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৩  |  2 comments

পৃথিবীর ইতিহাসে এত বেশী মিশ্র ভাবনা-সংস্কৃতি আর চারিত্রের সংমিশ্রণ নিয়ে আমরা বেড়ে ওঠছি যে, ব্যাতিক্রম বাদে সবাই আমরা নানা ক্ষেত্রে সংকীর্ণতার চরম পরিচয় দিয়ে থাকি। আমাদের নানা সংকীর্ণতার মধ্যে আমাদের সামনে মানুষের যে সংকীর্ণ পরিচয়টা সবচে বেশী ব্যাথিত করে তা হলো মানুষ সত্যটা বলে না। কেবল যে নিজের স্বার্থের জন্য তা নয়, কিছুটা ঈর্ষাকাতর, কিছুটা অযোগ্যতা, কিছুটা লোভ, কিছুটা ব্যার্থতা থেকেও মানুষ এই কাজ করে। আর তার প্রভাব পরে সংস্কৃতিতে। এর সবচে বড় উদাহরণ জীবনানন্দ দাশের সাথে রজনীকান্ত দাশ-দের আচরণ। এখানে অবশ্য একটি বিষয় একটু বেশীই কাজ করে, তা হলো অযোগ্যতা। বিষয়টা এমন দাঁড়ায় যে, আমি অধম তুমি উত্তম হইবে কেন? এমন বিষয় নিয়ে আজ (রোববার) সন্ধ্যায় কথা হচ্ছিলো একজনের সাথে। তিনি বলছিলেন, সমসাময়িকদের থেকে ইচ্ছাকৃত দূরে থাকি। কারণ তারা কখনোই সৎ নয়, সত্য কে সত্য আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে তারা আগ্রহী নয়। এই মুখোশে ভর্তি সময়ে তাই সত্যকে সত্য আর মিথ্যাকে যেমন বলাল মানুষের অভাব তেমন, ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলাও অনেক কঠিন। তবে আমি আজ একটি ভালোর কথাই বলবো। আর তা হলো কামার আহমেদ সাইমন ও সারা আফরীন নির্মিত ছবি শুনতে কি পাও এর কথা।
বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়, তবে যে কথাটা সবার শেষে অথবা সবার শুরুতে বলতে পারি তা হলো ছবিটা অনবদ্য। শুরুতেই একটু ছবির চারপাশ ঘুরে আসি। আমরা বই পড়ি, গান শুনি, ছবি দেখি, চিত্রকলা দেখি কি জন্যে? প্রত্যেকটা মহৎ শিল্পই তো আমাদের নতুন একটি জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় বা ঐ জগতে ভ্রমণ করিয়ে নিয়ে আসে। একটা চমৎকার বই পড়ার পর, বইয়ে লেখা চরিত্রগুলো যেমন আমাদের চারপাশে বিরাজ করে, তেমন একটা ভালো ছবির চরিত্রগুলোও কি তেমন করে না? আমার তেমনই হয়। আমি বুদ হয়ে থাকি মুগ্ধতা মাখা সেইসব বই পড়ে অথবা ছবি দেখে। আর বাংলাদেশের সিনেমা দেখতে গিয়ে নানা কারণে প্রত্যাশা শূন্য রেখে দেখতে হয়। তবে কিছুটা প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে। নয়তো এই প্রাপ্তি অপ্রাপ্তিতে রূপান্তর হয় বড় করুণ আকারে। এইসব প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির মাঝে হঠাৎ করে জ্বলে ওঠে সূর্য। ঝলসে যেতে চায় চোখ। তবে রেহাই মিলে, কারণ চোখগুলো এতদিনে আর টলমলে নেই।
কামার আহমেদ সাইমন ও সারা আফরীন তাঁদের ছবি শুনতে কি পাও এর জন্য একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। পৃথিবীর সবচে পুরনো চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনি হয়েছে এই ছবি দিয়ে (খবর ), প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউরোপের অন্যতম প্রামান্য উৎসবসিনেমা দ্যু রিলেমূল আর্ন্তজাতিক প্রতিযোগিতায়শ্রেষ্ঠ ছবি পুরষ্কার গ্রা প্রী পেয়েছে এই ছবি। এমন সংবাদ আমরা প্রতিবারই জেনেছি সংবাদ মাধ্যমে।  এমন সংবাদ পেলে কি ছবি দেখার আগ্রহ বাড়ে না? তো আমার বা আমাদেরো এমন আগ্রহ বেড়েছে। কিন্তু ছবি দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে না। কারণ, ছবিটির শো হচ্ছে না কোথাও। এর মাঝে একদিন খবরের কাগজে দেখলাম ছবির প্রিমিয়ার হয়ে গেছে পাবলিক লাইব্রেরিতে। প্রিমিয়ার হওয়ার আগে খবর পাই নি, খবর পাইলাম প্রিমিয়ারের পর। তাই আরো কিছুটা রাগ হলো। কদিন পর দেখলাম ছবিটার একটি শো হচ্ছে ঢাবির টিএসসিসে ডিইউএফএস এর আয়োজনে। খবরটা এমন সময় হাতে পাইলাম যে ততক্ষণে অফিস শিডিউল বদলানোর সুযোগ নেই। আবারো ক্ষেদ জমলো মনে। আর এই ক্ষেদ মিটানোর সুযোগ হলো সম্প্রতি নির্মাতার নিজস্ব আয়োজনে ছবি দেখার সুযোগ পেয়ে। সত্যি বলছি, ছবি দেখার পর ছবির নির্মাতা বা সংশ্লিষ্ট সকল মানুষের প্রতি আর কোনও অভিযোগ নেই। সংবাদ মাধ্যমে এই ছবি সম্পর্কে জেনেছিলাম এটি একটি প্রামাণ্যচিত্র। কিন্তু ছবি দেখার পর এই শব্দটির ব্যবহারকে আমার মনে হয়েছে ছবিটির অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এই ছবিটিকে আমরা প্রামাণ্যচিত্র না বলে যদি শুধু একটি সিনেমা বলি তবে তা পূর্ণতা পাবে। এমন কথাই পরিচালক ছবি শুরু হওয়ার আগে বলেছিলেন আমাদের। বলেছিলেন, ছবি দেখার সময় আপনারা ছবিটি প্রামাণ্যচিত্র না ফিচার ফিল্ম তা মাথায় না রেখে দেখবেন, দেখার পর যা মনে হয় বলবেন। হ্যা, তাই করেছিলাম। আর এখন বলতে হচ্ছে প্রামাণ্যচিত্রের যে তথাকথিত ফর্ম আমরা আগে দেখেছি, তা এখানে নেই। আবার ফিকশনেও যা দেখি তাও এখানে নেই। এখানে তবে কি আছে? এখানে আছে জীবন ও বাস্তবতা। আছে সংগ্রাম, প্রেম, দ্বন্দ্ব, রাজনীতি, অর্থনীতি, স্বপ্ন, স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প। এবার বলুন, এত কিছু যদি কোনও কিছুতে থাকে তবে তাকে কি আপনি প্রামাণ্যচিত্র বলবেন? এইসব তো পরিকল্পিত চিত্রনাট্যের সাজানো ছবিতে থাকে। হ্যা, এই ছবির চিত্রনাট্যও সাজানো। তবে তা বাস্তবকে দেখে, সেখান থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন সাইমন। আর এইসব খুঁজে খুঁজে বের করে তাঁর ছবির মালা গেথেছেন। এই কারণে ছবি দেখার সময় ভুলেই গিয়েছিলাম প্রামাণ্যচিত্র না ফিকশন দেখছি।
ছবির গল্পের মূল চরিত্র ৩ জন সংগ্রামী। তারা হলেন ২০০৯ সালের ২৫ মে বাংলাদেশে আঘাত হানা আইলায় আক্রান্ত একটি পরিবার। পরিবারটির প্রধান পুরুষ চরিত্র সৌমেন, প্রধান নারী চরিত্র রাখী ও তাদের চার বছর বয়স্ক একমাত্র সন্তান রাহুল। বাড়িঘর হারিয়ে আরো হাজার হাজার নারী পুরুষের সাথে যখন তারা পথে আশ্রয় নেয়। ছবির সমগ্রতা জুড়ে আছে এই তিনজন। এই তিনজনের জীবন ও তাদের চারপাশের মাধ্যমে উঠে এসেছে আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান,রাষ্ট্র ও তার অগোছালো জীবনের ছবি।নব্বই মিনিটের এই ছবি পর্দায় শেষ হলেও কিন্তু শেষ হয় না তাদের প্রতিদিনকার সংগ্রামের গল্প। কারণ, মানুষের সংগ্রাম যে শেষ হয় না কখনো,সে কথাও বলা আছে এই ছবিতে। 
শুরুতে যে কথা বলতে চেয়েছিলাম। তা হলো আমাদের সংকীর্ণতার সুযোগে জীবনানন্দ তার কবিতার খাতা ট্রাঙ্কে ভরে রাখে। আমরা এমন সংকীর্ণতাকে নিয়েই বেড়ে ওঠি, তাই আমাদের চারপাশে জীবনানন্দ-রা বারবার আসে না। তেমনি আমাদের দেশের সিনেমার রঙিন মানুষদের জগৎটা আরো লোভের, আরো রূঢ়। তাদের মুখ থেকে অন্যের ভালোটা বের হয় না। যতটা না বলে আম পাবলিক। আমাদের এইসব আশা-হতাশা নিয়েই যেহেতু বাঁচতে হবে, দেখতে হবে কিভাবে একটা শিল্পের ফুল গোবরে পদ্ম হয়ে ফুটে। তাই আমরাও প্রস্তুত হয়েই থাকি। সৌমেন, রাখি আর রাহুলরা যেমন প্রতিদিন সংগ্রাম করে ঝড়-তুফানের সঙ্গে পাশাপাশি আমরাও মুখে কুলুপ আটা সভ্যতার চারপাশেই বেড়ে ওঠি ফুলকে ফুল আর ময়লা আবর্জনাকে নোংরা বলে জানান দিতে।

বিষাদের কাঁচপোকাদের দখলে থেকে থেকে তো আমার আপনার চিন্তায় কিছুটা শ্যাওলা জমে আছে। শুনতে কি পাও- ছবি দেখার পর আপনার আমার মগজের সেই শ্যাওলা কাটিয়ে তুলবে বলে আশা করি। চাই এই ছবি দেখুক কোষ্ঠ-কাঠিন্যে ভরা বুদ্ধিজীবী, দেখে কিছু বলতে না পেরে মুখ লুকিয়ে প্রদর্শণী থেকে বেরিয়ে যাক। আর আমাদের পথে প্রান্তরের কোটি জনতা ছবির মানুষ হয়ে ওঠুক, দেখুক তাদের জীবন আমাদের চলচ্চিত্রে। কারণ, মনে করি যতদিন সাধারণ মানুষ চলচ্চিত্রের চরিত্র হয়ে উঠতে না পারে ততদিন আমাদের সিনেমা বদলাবে না। জয় হোক সিনেমার, জয় হোক সাধারণ মানুষের। 




Share
About the Author

Write admin description here..

২টি মন্তব্য:

  1. লেখা ভালো লাগল।

    ছবিটি দেখার আগ্রহ ছিলো...........

    লেখা পড়ে ও ট্রেলার দেথে আরো বাড়ল।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ধন্যবাদ সুজন ভাই। ছবিটিও শীঘ্রই দেখতে পাবেন বলে আশা রাখি।

      মুছুন

এই সাইটের যে কোনও লেখা যে কেউ অনলাইনে ব্যবহার করতে পারবে। তবে লেখকের নাম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।

Blogger template Proudly Powered by Blogger. Arranged By: এতক্ষণে অরিন্দম