ফ্রানৎস কাফকা একটা জাদুর নাম। সাহিত্যের পাঠকদের কাছে এই কথা নতুন করে বলার কিছু নাই। আমার বদ স্বভাব, যারে মানুষ বেশী গুরুত্ব দেয় তারে একটু এড়াইয়া চলি। যদি না সে আবার আমার ঘাড়ে আছড় হয় এই ভয়ে। কসম, কইতেছি- প্রিয় জীবনানন্দের কবিতা প্রথম পড়ার পর আমি তারে এড়াইয়া চলতাম। এখনো এই বদ স্বভাব যায় নাই। এই কারণে আমার নানান সময় নানান ভাবে পস্তাইতে হয়। কাফকা যে একটা জাদু, তা জানতাম এবং মানিও। কিন্তু সমস্যা হইতেছে যেই চোদনা (বাজে অর্থে নিবেন না প্লিজ) বিশ্ব সাহিত্যের তাবৎ পোংটাদের মাঝে সবচে বেশী প্রভাব খাটাইতে পারে, তারে হজম করতে গিয়া না আমি নিজেই হজম হইয়া যাই, এই ভয়ে আমি কাফকারেও এড়াইয়া চলছি অনেক দিন।
সিনেমার ক্ষেত্রেও আমি প্রায় একই নীতি মানি। যেসব ছবি বা নির্মাতারা চারপাশের মানুষকে বেশী মুগ্ধ করে তাদের ক্লাসিক কর্ম আমি দেখতে চাই না। বলতে গেলে সাহস পাই না। যদি কোনও জড়তা কাজ করে এই ভয়ে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমার এই ভয় কাটানোর পেছনে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এর অনেক বড় অবদান। এক সাক্ষাৎকারে জীবনানন্দরে প্রশ্ন করার পর আমার উত্তর শুনে তিনি বলছিলেন, জীবনানন্দরে যে ভয় করো। ভয় কাটানোর জন্যও তোমার বেশি করে পড়া দরকার। এখন অবশ্য তাই করি। বেশী করে পড়ি, আর বেশী করে ছবি দেখি।
তো ফ্রানৎস কাফকারেও আমি এমনি করে ভয় করে এসেছি এতকাল। যদিও তার সাহিত্যের মূল বিষয় সম্পর্কে আমি পরিচিত ছিলাম। পড়েছিলামও কিছু। কিছুই। পুরোপুরি না। তবে হঠাৎ নতুন করে পড়ার আগ্রহ তৈরি হইলো। তার আগে হাতে থাকা ছবি স্টিভেন সোডারবার্গের নির্মাণ কাফকা দেখতে মন চাইলো। বসে পড়লাম। দেখি কি হয়। কাফকার বায়োগ্রাফি দেখায় না, না কাফকার সাহিত্যের জগত দেখায় তা দেখার জন্য বসলাম। ১৯৯১ সালের ছবি। এই সময় তো রঙিন সিনেমার জন্য কোনও কমতি ছিলো না। কিন্তু সাদা কালো কেন? একটু বিরক্তি নিয়া ছবি দেখতে বসলাম। ছবির সাউন্ড কোয়ালটির কারণে সংলাপগুলো আমার কানে একটু কমই আসছিলো। পূর্ণাঙ্গ মনযোগ না দিয়ে ছবি দেখতে চাই তবে তার অধিকাংশই আমার কানে ঢুকবে না। তাই প্রথম কিস্তিতে মাত্র ৩০ মিনিট দেখে ক্ষ্যামা দিলাম। কারণ নানা ঝুট ঝামেলায় মনযোগ দেয়াটা একটু কষ্টই হচ্ছিলো। আর সাদাকালো ছবিতে একটু কষ্ট করেই মনযোগ দিতে হয় আমার। সব মিলে প্রথমবার বসায় ৩০ মিনিট দেখে আমি ঠিক বুঝে ওঠতে পারতেছিলাম না। যে বায়োগ্রাফিমূলক ছবি দেখতে বসছি না তার কর্ম নিয়ে। তবে হ্যা, দ্বিতীয় কিস্তিতে বসেই ছবিটায় আমি ঢুকে গেছিলাম। তার আগে একবার চোখ ফিরাই তার সম্পর্কে উইকি কি বলে।
মুক্ত জ্ঞান চর্চার এই মাধ্যম কয়, ফ্রানৎস কাফকা ছিলেন কথা সাহিত্যিক, ছোটগল্পকার ও বীমা কর্মকর্তা। এই তথ্যটায় এসে চোখ আটকে যায়। হ্যা, বীমা কর্মকর্তা এই ভদ্রলোক এক অদ্ভুত ব্যক্তি ছিলেন। তার বাস্তবের জীবনে তিনি তৈরি করেছিলেন এক ভিন্ন জগত। হ্যা। সেই জগতকে তিনি আবার তার মতো করেই বাস্তবে নিয়ে এসেছিলেন। অনেকটা ফ্রাঙ্কেস্টাইনের মতো। তবে হ্যা, ফ্রাঙ্কেস্টাইনের নির্মিত দানব যেমন তাকেই খুন করেছিলো, তেমন কাফকার জাদুর জগত তাকে তেমন কিছু করতে পারে নাই। করেছে তার পরবর্তিকালের দুনিয়ার বড় বড় সাহিত্যিকে। বলতে গেলে তার সৃষ্ট জাদুর মায়ায় বন্দী করেছে। এই জাদুর গল্পই আমরা দেখেছি সোডারবার্গের নির্মিত কাফকা ছবিতে। পুরো ছবির গল্প আমি বলতে নারাজ। ৯৪ মিনিটের এই ছবি আমি প্রথমবারে তিন ভাগে দেখি। দ্বিতীবার আমি এক বসায় (বলতে গেলে এক নিঃশ্বাসে) দেখে ওঠি। ছবির ৭০ মিনিটের সময় শুরু হওয়া ১৪ মিনিটের একটা স্বপ্ন দৃশ্য রঙিন করে চিত্রায়িত। হঠাৎই ঐ দৃশ্য শেষ হয়ে গেলে আবার বাস্তব জীবনের মতো সাদাকালো। এই রঙীন দৃশ্যের ভেতর দিয়ে সোডাবার্গ কাফকার সৃষ্টি জগতের ভেতর ঘুরপাক খাওয়া দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন কিভাবে জীবনের নিজের জগতের ভিতর বসবাস করতে গিয়ে নিজেই বিপদ ডেকে আনা বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে হয়। এইখানটাই আসলে পার্থক্য গড়ে দেয় অন্য বায়োগ্রাফিক্যাল ছবির সাথে। সিনেমা দেখিয়ে দেয়, কেবল কাজ বা জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই সব কিছু নয়। আরো কিছু থাকে। রয়ে যায় গোপন কুঠুরিতে।
সোডাবার্গ এমনিতেই বিশ্বখ্যাত নির্মাতা। পরবর্তিকালে সে চে’গুয়েভারার মতো ব্যক্তিত্বকে নিয়ে দুই পর্বের ছবিও বানিয়েছেন। চে’র বিপ্লব আর বিপ্লবোত্তর জীবনের পাশাপাশি রাজনৈতিক জীবনকেও তুলে ধরেছিলো সোডারবার্গের দুই পর্বে ছবি। কিন্তু কাফকার মতো এত কমপ্লিকেটেড একটা মানুষের জন্য বরাদ্দ মাত্র ৯৪ মিনিট? হ্যা, এই কথাই একটু আগেও বললাম যে কাফকার যে অন্তবর্তীকালীন জীবন। একজন বীমা কর্মকর্তার পরিচয়ের সমান্তরালে যেই জীবনের কর্মে কিনা প্রভাবিত আধুনিক বিশ্ব সাহিত্যের অনেক রথী-মহারথী তার জীবনকে তো একটা প্রতীক দিয়েই চেনাতে হবে। নইলে যে কুল কিনারা করা যাবে না। সেই পথেই এগিয়েছে সোডারবার্গ। তবে হ্যা, এই ছবির চিত্রনাট্য কিন্তু সোডাবার্গ লিখে নাই। লিম ডবস নামের ঐ চিত্রনাট্য খুব উঁচু মানের চিত্রনাট্যকারও না। অন্তত আইএমডিবি ছবির রেটিং দেয় মাত্র ৬.৯। আর তেমন পুরস্কারও জোটে নাই ছবির ভাগ্যে। কিন্তু আমার মন জয় করলে তো আর ঐসবে কিছু হয় না। তাই আমি মুগ্ধ হয়ে তার কথায়ই বলি-লিখি। (যদিও আঁতেলের বিচি বলে কেউ কেউ আমারে ইতিমধ্যে চিহ্নিত করছে। তাদের বলি, ভাই বিচিদের থেকে দূরে থাকেন। কখন ফুইট্যা গাছ হইয়া যায়, তখন তো আপনার খাড়ানোর জায়গাও থাকবো না।) আপনার সময় হইলে তাই কাফকার ভিজ্যুয়াল জগতে একটু ডুব দিয়া আসতে পারেন।
0 মন্তব্য(গুলি):