বুধবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৩

আমি যে ছবিটি বানাতে চাই

at বুধবার, জানুয়ারী ২৩, ২০১৩  |  No comments

তাইওয়ানের ডিরেক্টর অং-কার ওয়াই এর একটা ছবি দেখতে বসেছিলাম। ছবিটার নাম হ্যাপি টুগেদার। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া এ ছবি বিশ্বের বেশ কয়েকটি বড় বড় চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পেয়েছে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচকদের কাছ থেকে পেয়ে অনেক প্রশংসাসূচক বাক্য। ছবিটার গল্পের মুল বিষয় হলও প্রেম। কিন্তু এই প্রেম রোমিও-জুলিয়েট, শিরি-ফরহাদ বা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের মতো তো নয়ই বরং বলা যায়, স্বাভাবিক জীবনের একটি ছেলের সাথে একটি মেয়ের প্রেমের গল্প নয়। গল্পটি একটি ছেলের সাথে একটি ছেলের প্রেমের। আর এই প্রেমের পাশাপাশি এখানে যৌন জীবনও এসে হাজির। একটি ছেলের সাথে একটি ছেলের যখন যৌন জীবনের সম্পর্ক তৈরি হয়, তখন সেটাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বা সমাজ জীবনের চোখে স্বাভাবিক যৌন জীবন হিসেবে উল্লেখ করা হয় না। তখন এই অবস্থাটাকে চিহ্নায়ন করার জন্য পৃথক শব্দ ব্যবহার করা হয়, আর তা হলও ‘সমকাম’। এই সমকাম শুধু ছেলেদের মাঝেই নয়, মেয়েদের মাঝেও রয়েছে। আর এই বিষয়ক একটি জীবনের গল্প নিয়ে আমি প্রথম যে ছবিটি দেখি তা দীপা মেহতার ‘ফায়ার’। এ ছবিতে দুই জন বিবাহিত নারী এই রকম একটি যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। আর সেই চরিত্র দুটো রূপায়ন করেছিলো শাবানা আজমি ও নন্দিতা দাশ। পর্দায় সম-লিঙ্গের যৌন সম্পর্কের ছবি দেখার সেই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। পরবর্তীতে আমি অনেক ছবি দেখেছি যার মাঝে সম-লিঙ্গের সম্পর্কের গল্প রয়েছে। সেইসব ছবির মাঝে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলও ‘ব্রোকব্যাক মাউন্টেন’, ‘রোম ইন দ্যা রুম’, ‘দ্যা বোং কানেকশনসহ অনেক। এইসব ছবির পাশে একটা ছেলের সাথে আর একটা ছেলের যৌন সম্পর্কের গল্প আমি দেখেছি ভারতীয় ছবি ‘আই এম’ এ। তবে সেখানকার প্রেক্ষাপটটা আরও ভিন্ন। সেখানে একজন পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ তার স্ত্রীর প্রথম পক্ষের ছেলে শিশুটিকে যৌন নির্যাতন করতো। এই নির্যাতনটা মূলত ঐ শিশুটির জীবনের ভবিষ্যৎ ভাবনায় এক বড় প্রভাব ফেলে পরবর্তীতে। সে মেয়েদেরও এড়িয়ে চলতে চায়। চায় কুৎসিত যৌন জীবনকে অতিক্রম করে একটা নিজের মতো জীবন গড়তে। যদিও সেটা স্বাভাবিক জীবন নয়, কিন্তু সেও এক সময় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। ফিরে আসলেও তার শৈশবের সেইসব নির্যাতনের স্মৃতি তাকে সব সময়ই তাড়িয়ে বেড়ায়। এই সেক্স এবিউজের যে অভিজ্ঞতা এই বিষয়টি নিয়ে আমার দেখা ছবির ভেতর ছবির ভাগ নেই বললেই চলে। স-বেধন নীলমণি ঐ ‘আই এম’। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে আমার ভাবনা রয়েছে। আমি মনে করি আমাদের সমাজে শিশু ও শৈশবের এমন যৌন নির্যাতনের ফলে নির্যাতিতার মস্তিষ্কে এক ধরণের চাপ তৈরি হয়। আর এই চাপের ফলে সেই শিশুটি যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হয় তখনো তার ভেতর এই স্বাভাবিক জীবনের অংশ হিসেবে যৌন জীবন নিয়ে এক ধরণের কমপ্লেক্স কাজ করে। যার ফলে সে মানসিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীনও হতে পারে। আবার উল্টো ফলও দেখা দিতে পারে ঐ প্রাপ্ত বয়স্ক যুবকটির মনে। সে হয়ে উঠতে পারে বিকৃত যৌন মানসিকতার ধারক। আর এর প্রভাব পড়বে সমাজে। সাম্প্রতিক কালে একের পর এক বিশ্রী যৌন অত্যাচারের খবরগুলোও এমনই কোনও বিকৃত যৌন চেতনার ধারকের ফলে হয়ে থাকতে পারে। এর পেছনের কারণ হিসেবে আমি ধারণা করতে পারি শৈশবের যৌন নির্যাতনের শিকারকে। আর এই একটা ছেলের (পূর্ণ বয়স্ক যুবকের) কাছে একটা শিশুর যৌন নির্যাতনের ঘটনা যে আমাদের সমাজেও ঘটছে বা ঘটে আসছে এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত সমাজকর্মী বা শিল্পের কোনও শাখাতেই তার প্রকাশ দেখি নি। আমাদের চলচ্চিত্রে তো নয়ই। অথচ তা আসাটাও কিন্তু জরুরী। একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা করা যেতে পারে এই নির্যাতনটি কি পরিমাণ ভয়ঙ্কর ও জঘন্য।
বছর দেড়েক আগে আমি তখন দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় কাজ করি। মরে যাওয়া পত্রিকাটি তখন নতুন যৌবনের উদ্যম নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছিলো। তখন একদিন হঠাৎ নিউজ ডেস্কে আমার হাতে একটি খবর সম্পাদনের জন্য আসে। খবরটি পরে আমি অনেকটা অবাক হই। খবরটি একটি খুনের ঘটনার। উত্তরায় এক কিশোর কর্তৃক এক মোবাইল ফোন রি-চার্জ ব্যবসায়ী খুন হন। পুলিশ ঐ কিশোর ছেলেটিকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ছেলেটি তার দোষ স্বীকার করে। খুন হওয়া ব্যক্তিটি একজন মোল্লা টাইপের মানুষ ছিলও। নামাজ পড়তো। মুখ ভর্তি দাড়ি ছিলও। এই লোকটিকে একটা কিশোর ছেলে কেনও খুন করতে পারে বলে মনে হয়? ছেলেটি তার দোকানে কর্মচারীর কাজ করতো। তবে কি ছেলেটিকে লোকটি নির্যাতন করতো? পরিশ্রম বেশী করাতো আর পারিশ্রমিক কম দিতো? এইসব ক্ষেত্রে আমাদের দেশে মানুষ এখনো ততটা হিংস্র হয়ে প্রতিবাদ করে থাকে না। এই খুনের ঘটনার পেছনে যেই নির্যাতনের ঘটনাটি পাওয়া যায় তখন তা হলও ঐ মোল্লা টাইপের লোকটি ঐ ছেলেটিকে যৌন নির্যাতন করতো। এবং ঘটনা এক সময় যখন তার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে, তখন ছেলেটি তাকে রাগ বা ঝোঁকের মাথায় খুন করে ফেলে। আমি যখন খবরটি সম্পাদনা করে বার্তা প্রধানের ডেস্কে দিয়ে দেই তিনি তখন এই সংবাদটিকে এক কলামের একটি স্থান বরাদ্দ করতে বলে। আমি তখন প্রতিবাদ করে বলি, এই ধরনের যৌন নির্যাতন দেশে হর হামেশাই হচ্ছে কিন্তু নানান কারণে খবরে আসছে না। কি পরিমাণ জঘন্য অত্যাচারের মুখোমুখি হলে একটা ছেলে একটা মানুষকে খুন করতে পারে এই ঘটনা তার প্রমাণ দেয়। তাই এটা বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। আমার কথায় সেদিন ঐ খবরটি শেষের পাতায় বক্স আইটেম করে প্রকাশিত হয়েছিলো। এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমিও হয়েছি। তখন আমি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ি, আমাদের পাড়ায় আমার সম বয়সী এক বন্ধু তার প্রতিবেশী এক সাহেব কাছে ডাকলে না যাওয়ায় আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কেন তার কাছে সে যেতে চায় না। সে বলতে চাইতো না। আমি জোর করায় সে হাতের আঙুল দিয়ে এমন কিছু বিশ্রী ইঙ্গিত করেছিলো যে, তাতে আমার বুঝতে বাকি ছিলও না ঐ লোকটির কোনও এক সময়কার লালসার শিকার হয়েছিলো আমার বন্ধুটি। সাম্প্রতিক সময়েও আমি আমার চারপাশের বেশ কিছু বন্ধুদের সাথে কথা বলে জেনেছি, তাদের মাঝেও কেউ কেউ শৈশবে এমন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় এই নির্যাতনের পদ্ধতিটি একটি ধারাবাহিক ব্যাধির মতো আমরা আমাদের সমাজে বহন করে চলেছি। কিন্তু রোগটি যে আছে সে বিষয়েই সচেতন নই। ডাক্তার দেখাবো কি করে? আমি আমার সেই বন্ধুর অভিজ্ঞতাটার কথা স্মরণ করেছিলাম সম্প্রতি। হিসেব করে দেখলাম, প্রায় কুড়ি বছর আগের ঘটনা। এখনো গা ঘিন ঘিন করে, আমাদের সমাজ এতই কুণ্ঠিত এক বসতি যে আমরা আমাদের গ্লানিকর ঘটনাগুলো পর্যন্ত বলতে সাহস পাই না। কিন্তু এ খাঁচা যে ভাঙতেই হবে। না ভাঙলে এ থেকে যে মুক্তি নেই তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তাই যে ছবিটা আমি প্রথমেই বানাতে চাই, সেই ছবিটা আমি শুধু সেইসব শিশু-তরুণ-যুবকদের গল্প নিয়েই বানাতে চাই। যাতে আমাদের চারপাশের জীবনটাই তার মুখ দেখাবে।

Share
About the Author

Write admin description here..

0 মন্তব্য(গুলি):

এই সাইটের যে কোনও লেখা যে কেউ অনলাইনে ব্যবহার করতে পারবে। তবে লেখকের নাম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।

Blogger template Proudly Powered by Blogger. Arranged By: এতক্ষণে অরিন্দম