শুক্রবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৫

যেইখানে একই নিয়মে সূর্য উঠে ও ডুবে

at শুক্রবার, ডিসেম্বর ১১, ২০১৫  |  No comments

 

ধরেন মগবাজারের জ্যামে বইসা আছেন। তখন নিজেরে নিশ্চয়ই আপনে গালি দিবেন, তিরস্কার করবেন। বলবেন, ঢাকা শহরের মানুষ না হইলে কত্ত আরাম। মগবাজারের জ্যাম-এ পরতে হয় না। আবার একই রকম মনে হইবো আপ্নের রামপুরা ব্রীজ, মালিবাগ, বনানী সিগনাল, পুরান ঢাকার সর্বত্র। আর রাতের বেলা যখন রাস্তা ফাঁকা থাকে তখন? উত্তরা থেকে পলাশির মোড় যাইতে সর্বোচ্চ ২০ মিনিট। অন্য সময়ে আপনার হয়তো এইটুক রাস্তা যাইতে দুই ঘন্টা বা তার বেশী লাগে। কিন্তু আপনার যেই গতিতে চলার কথা, সেই গতিতে চলতেছেন। রাস্তায়ও কোনও জ্যাম নাই। কিন্তু ত্রিশ মিনিট আগে যেইখানে ছিলেন এখনো সেইখানেই তখন আপনার কেমন লাগবে? আপনার কেমন লাগবে আমি জানি না। তবে আমি এই রকমই বিভ্রান্ত হইছিলাম দুই দিন আগে।

হাওড়ের জীবনটা নদী থেকে দেখার ইচ্ছায়, ট্রলারে করে ফিরতেছি। দূরে একটা গ্রাম দেখাইয়া পাশের মুরুব্বীরে জিগাইলাম, মুরব্বী এইটা কোন গ্রাম? মুরুব্বী জানাইলেন, গ্রামের নাম জগন্নাথপুর। আচ্ছা। আধঘন্টা পর আবারো আরেকটা গ্রাম দেখাইয়া জিগাইলাম। ট্রলারের ছাদের বিকেলের রোদে বসা মুরুব্বী একবার তাকাইলেন গ্রামের দিকে। উত্তর দিলেন, জগন্নাথপুর! মানে? আধাঘন্টা ধইরা কি তবে আগাইতেছি না? আমার প্রশ্নে মুরুব্বী স্মিত হেসে উত্তর দিলেন। নদী পথ তো, এই রকমই। আমরা এতক্ষণ পূবে ছিলাম, এখন উত্তরে। তার মানে নদী যেদিক দিয়া গেছে আমরাও এইদিক দিয়াই যাইতেছি। অ আচ্ছা।

এইটা হৈলো খালিয়াজুড়ি থেকে ট্রলারে করে নাওটানা ফেরার অভিজ্ঞতা। কুয়াশা না থাকলে নাওটানা থেকে ট্রলারের ছাদে উঠলে খালিয়াজুড়ি দেখা যায়। উপজেলা সদরটা এত ছোট যে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাইতে পাঁচ-দশ মিনিট হাঁটলেই চলে। শুকনা মৌসুমে তবুও নৌকা ছাড়া যাতায়াত করার উপায় আছে। মানে দুই ধরনের ট্রান্সপোর্ট আছে। এক হইলো ভটভটি, আর এক হইলো ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেল। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে? নৌকা ছাড়া কোনও উপায় নাই। চারপাশে তাকালে কেবল মনে হয় ঢেউ ছাড়া সমুদ্র। আর গ্রামগুলো হঠাৎ হঠাৎ একটা দ্বীপের মতোন।

বলা যায় বাংলাদেশের অন্যতম দুর্গম উপজেলাগুলোর একটা হইলো এই খালিয়াজুড়ি। ঢাকা থেকে সবচে সহজ পথেও যাইতে হইলে আপনাকে চারবার ট্রান্সপোর্ট বদল করতে হবে। এর মাঝে স্থলপথ ও নদীপথের একাধিক মাধ্যম আপনাকে গ্রহণ করতে হবেই। এক কথায় খালিয়াজুড়ির এই হৈলো বিশেষত্য। এখানকার মানুষ খুব বেশী কিছু চায় না। তাদের প্রয়োজনীয় যা যা দরকার তারা কেবল তাই চায়। যেমন? তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না। যা আছে তাতেই তারা সন্তুষ্ট। তবে যেই বিষয়টা এখানকার মানুষদের কথা চিন্তা করলে সবচে বেশী যন্ত্রণা দেয় তা হইলো এখানকার অর্থনৈতিক জীবন কাঠামো খুবই দুর্বল। বছরে ছয় মাস তাদের কোনও রোজগার থাকে না। কেবলমাত্র মাছ ধরা ছাড়া। কেউ কেউ এই সময় অর্থের অভাবে এলাকা ছেড়ে ডাঙ্গায় কাজের উদ্দেশ্যে পারি জমায়। অথচ আপাত দৃষ্টিতে খুব স্বাধারণ একটা জায়গা হইলেও শীতের সকালে এইসব গ্রামগুলো কি যে সুন্দর হয়ে উঠে। আর কি যে অপার্থিব নীরবতা সেইসব গ্রামে। আমার ব্যার্থতা সেই নীরবতাকে আমি ধারণ করতে পারিনি। উল্টো আরো মুখর হয়ে ফিরে এসেছি। আসা যাওয়ার পথে বয়ে বেড়িয়েছি অন্য যাতনা। অথচ যা স্বাভাবিক ছিলো না কিছুতেই।
খালিয়াজুড়ির খুব ধীর গতির। যেহেতু ছোট মফস্বল। তাই সেখানকার অধিকাংশ মানুষের মন ছোট, এমনটা সেইখানে যারা কাজ করতে যায় তারা বলে। তবে এর বিপরীত চিত্রও আমরা দেখতে পাই।

তবে অর্থনৈতিক কাঠামো দুর্বল হইলেও বাংলাদেশের আদী ও অকৃত্রিম যে রূপ তার অনেকটাই কিন্তু সেই খালিয়াজুড়িতে পাওয়া যায়। শীত মৌসুমে যখন হাওর অঞ্চল শুকনো থাকে তখন সেখানে শীত যাপনের জন্য পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে স্থানীয়দের অর্থের সংকটটা কমতো। আমার এমনই ভাবনা। তাই শীত থাকতে থাকতে আমি মনে হয় আবারো যাবো খালিয়াজুড়ি।



কীভাবে যেতে পারেন খালিয়াজুড়ি
দুই পথে খালিয়াজুড়ি যাওয়া যায়। তবে সবচে সহজ ও দ্রুততর পথ হলো মোহনগঞ্জ হয়ে। ঢাকা থেকে হাওর এক্সপ্রেস এ চড়ে সোজা মোহনগঞ্জ। ভাড়া চেয়ার কোচে ২১০ টাকা। শোভন ১৫০। মোহনগঞ্জ স্টেশনের কাছ থেকেই সিএনজি চলে বোয়ালিয়া পর্যন্ত। প্রতিটা সিএনজিতে ৫জন করে তোলে। জন প্রতি ভাড়া ৬০ টাকা। বোয়ালিয়া গিয়ে একটা নদী পার হইতে হবে। ব্রীজ আছে। এইখান থেকেই মূলত: হাওর অঞ্চল শুরু। বর্ষায় এইখান থেকেই সরাসরি খালিয়াজুড়ি বা হাওরের যে কোনও থানা, গ্রামের ট্রলার যায়। ব্রীজ পার হয়ে মোটর সাইকেলে করে সরাসরি খালিয়াজুড়ি যাওয়া যায়। এতে সময় কম লাগে। আর মূল পাকা রাস্তাটাও চেনা হয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ থাকে। তবে খরচ একটু বেশী। দুইজন যাত্রী তোলে। ভাড়া ৩শ টাকা। সময় লাগে মাত্র ৪০ মিনিট। আর এখান থেকে মোটরসাইকেলে নাওটানা গিয়ে সেখান থেকে সকাল ৮টার ট্রলারে খালিয়াজুড়ি যাওয়া যায়। নদীপথে, ভাড়া মাত্র ৪০ টাকা। তবে নদীপথে সময় লাগে দেড় ঘন্টা। তারপর নাওটানা পর্যন্ত তো যেতেই মোটরসাইকেলে ১৫ মিনিটের বেশী লাগে না। দুইজনে ভাড়া নেয় ১শ টাকা।

একে তো দুর্গম পথ তারওপর, জনপ্রিয় কোনও ট্যুরিস্ট স্পট না। তবুও আপনার ভালো লাগবে। যদিও মন্দ লাগার মতোও অনেক কিছু আছে সেখানে, আপনি তো আর সেগুলোর জন্য যাচ্ছেন না। 

সবগুলো ছবি তুলেছেন তানভীর আশিক

Share
About the Author

Write admin description here..

0 মন্তব্য(গুলি):

এই সাইটের যে কোনও লেখা যে কেউ অনলাইনে ব্যবহার করতে পারবে। তবে লেখকের নাম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।

Blogger template Proudly Powered by Blogger. Arranged By: এতক্ষণে অরিন্দম