'এমন না
যে রমিজের জীবনে এ ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। তবুও যেদিন বিষ্যুদবার, কুলুকুলু হাওয়া
বয়। রমিজ গাছে উঠে,
ভোরে। শালিখ পাখির বাসা পার হয়ে বিমান ধরে।'
বাস্তব নয়, তবে ভিস্যুয়াল
বা ভার্চুয়াল যাই বলি না কেন রমিজের সাথে আমার পরিচয় প্রায় দশ বছর আগে। ময়মনসিংহের
তিন কোনা পুকুর পাড়ের মেস বাড়িতে আমাদের কয়েকজনের মধ্যরাতের বিনোদন ছিলো দুটি টিভি
ধারাবাহিক। যার একটা ছিলো ‘রঙের
মানুষ’ আর একটা ‘রমিজের
আয়না’। সেইটা ছিলো আমাদের অনেকের দেখা সবশেষ
টিভি ধারাবাহিক। তারপর আর টিভি ধারাবাহিক দেখার সময়-সুযোগ ও আগ্রহ কোনওটাই হয় নি।
যদিও বিদেশী টিভি সিরিজ দেখা হয় কিছু। তবে এর মাঝে হালের জনপ্রিয় ‘গেইম অব থ্রোনস’ এর মতো সিরিজও আমি মিস করছি। আগ্রহই তৈরি হয় নি। আমার এরকম
হয়। আবার শার্লকের মতো সিরিজ আমি নিয়মিত দেখি। আগ্রহ তৈরি হয় বলেই আমি দেখি। যাই
হোক, টিভি ধারাবাহিক নিয়ে বকর বকর মুখ্য বিষয় না। মুখ্য হলো রমিজ। যেই রমিজের আয়নায় আমার
ভার্চুয়াল/পর্দার রমিজের সাথে পরিচয়। যেই রমিজ কাজের খোঁজে ঢাকায় এসে এক অদ্ভুত
জটিলতার মুখোমুখি হয়। সেই রমিজ যাপিত জীবনের তাগিদে ধীরে ধীরে এক পঙ্কিল পৃথিবীতে
ঢুকে যায়। যেমন আমরাও ঢুকে আছি। কেউ হয়তো স্বীকার করবেন, কেউ করবেন না। কিন্তু প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই নাটুকে রমিজের মতো
পঙ্কিলতা আছে। তবে নাটকের রমিজও কিন্তু আমার আলোচনার বিষয় নয়। আমার আলোচনার বিষয়
অন্য রমিজ। সেই রমিজও নাটকের রমিজের মতো জ্যামে বসে থাকে। গরমে ঘেমে একাকার হয়।
বিরক্তিতে মুখ বাকানো ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। তবে সেই রমিজও স্বপ্ন দেখে এইসব
পঙ্কিলতা, যন্ত্রণাকে এড়িয়ে একটা সুন্দর পৃথিবীর। সেই সুন্দর
পৃথিবীটা কি হইতে পারে সেই আলোচনা অন্য কোনও দিন করা যাইতে পারে। যেহেতু আমাদের ‘এই দিন দিন না, আরও দিন আছে’।
রমিজের প্রসঙ্গটা আসছে সে আসলে
আমাদের কাছে বাস্তব হয়ে দাঁড়াইছে বলে। কারণ আমাদের ‘রমিজের
বাড়ি’ও আছে। শেষবার আমি রমিজের সেই বাড়ি গেছিলাম তখন
শুক্রবার। তার আগেও গেছিলাম। সেইটাও শুক্রবার ছিলো। শুক্রবারে রমিজের বাড়িতে মনে
হয় গেস্ট একটু বেশী থাকে। যাই হোক, রমিজের বাড়িটা বেশিদিন
টিকবে না। সেখানে অন্য কেউ বাড়ি করবে। কারণ রমিজ বাড়ি করছে ঢাকার মোহাম্মদপুরের
আর্টস গ্যালারি ‘কলা কেন্দ্র’তে।
তার বাড়ির মেয়াদ ডিসেম্বরের দশ তারিখ পর্যন্ত। এই কয়দিন পর্যন্ত রমিজের বাড়িটার
প্রাতিষ্ঠানিক নাম ‘হাউ ডু আই রেন্ট এ প্লেইন’। এইটা কবি ও শিল্পী রাজীব দত্ত’র প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী।
রাজীবের সেই পৃথিবীকে রাজীব বলে
অর্থহীন। আসলেই তো অর্থহীন। কিন্তু বললেই কি অর্থহীনতা দাঁড়ায়। বিষয়টা আসলে কি? পরীক্ষার প্রশ্নের মতো যদি উত্তর খুঁজি, অর্থহীনতা
বলতে কি বুঝি? কীভাবে অর্থহীনতা বাস্তবতায় রূপ নেয়? এইসব জটিল প্রশ্নের আপাত: সহজ উত্তর আসলে ঐ
প্রদর্শনীটা। এক ধরনের প্রশ্ন ফাঁস করে দেয়ার মতো। তবে এই প্রশ্ন আর এই উত্তর হাতে
পেলেও আপনি রমিজ সম্পর্কে ঠিক উত্তরটি লিখতে পারবেন না। রাজীবের জগৎটা এমনই। কেমন?
এক টিভি সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা
আপনার প্রদর্শনীর নাম ‘হাউ ডু আই
রেন্ট এ প্লেইন’ কেনো? ছোটখাটো মানুষটার
উত্তরটাও ছোট। বলে কী না, ‘আমার
যদি একটা প্লেইন থাকতো তাইলে তো জ্যামের মধ্যে গরমের মধ্যে বসে কষ্ট করতে হইতো না।
তো রমিজেরও এই রকম ইচ্ছা করে। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে একটা করে রমিজ আছে’। আরে বলে কি! প্রত্যেকের মধ্যে রমিজ আছে? এই কথাই তো শুরুতে বলতে
চাইছিলাম।
হ্যা, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে যে রমিজ আছে। আর সেই রমিজ যে বিভিন্ন সময় এলোমেলো
ভাবনাগুলো ভাবে সেগুলোই অনেকাংশে এই প্রদর্শনীর দেয়াল জুড়ে। যেমন রমিজকে আমরা পলাশী’র আম বাগানে দেখতে পাই। সেইখানে গিয়া রমিজ কি করে? রাজীবের ভাষ্যে যদি উত্তর খুঁজি তবে পাই, “পলাশীর আম্র কাননে রমিজ। এই রমিজকে ১৭৫৭ সালের আগে দেখা যায়
নাই। সিরাজ ও রমিজ লর্ড ক্লাইভের হাতে মরিচ আর নুন জিম্মা রাখছে।” পলাশীর আম বাগানে যদি বাংলার স্বাধীনতার প্রথম পতন হিসেবে
দেখি, তাহলে ভাবতেই পারি এই যে আমরা যারা ইতিহাসের কিছু সংখ্যা আর
তাদের ভাব সম্প্রসারণ জানি, তারা সবাই তো রমিজই। কারণ সিরাজ
তো আমাদের নিয়া সেই সময় ক্লাইভের কাছেই সব কিছু সমর্পণ করছিলো। ইতিহাস তো তাই বলে।
এইভাবে রমিজের আপাত: ‘অর্থহীন’ ভাষ্য আমাদের একটা নয়া দুইন্যার সামনে দাঁড় করাইয়া দেয়।
আমরা অর্থহীনতার মাঝেও অর্থ পাইছি।
রাজীবের এই জগতের সাথে পরিচিত
হইতে পারা দারুন। যারা ভার্চুয়াল জীবন কিছুটা হৈলেও যাপন করেন, তাদের কাছে তার এই জগৎ পুরোপুরি নতুন না হইলেও একেবারে পুরাতনও না। কিন্তু
যেই বিষয়টা না বললেই নয়, তা হইলো দৈত্য (রাজীব দত্ত কে আমি দৈত্য’ই ডাকি, হয়তো আরও কেউ কেউ ডাকে) তার শিল্পকলার মধ্য দিয়ে
একটা অর্থহীন গল্প বলছেন। এই গল্পেরও একটা খন্ড খন্ড অর্থ যেহেতু আমাদের কাছে
দাঁড়ায়া যায়, তাই একটা সামগ্রিক অর্থও দাঁড়াইতে পারে। যেমন
দৈত্য’র ছবিতে যখন লেখা থাকে “পাখিরা কখনো রান্না করা মাছ খেয়ে দেখে নি। তাই তার পোষা
রাখির জন্য রমিজ রান্না মাছ নিয়ে যায়। রমিজ গাছে উঠে পাখিকে পাখির মতো ডাকে- আসো খাই, মাছ খাই। (পাখিদের একটা
পায়ে লোম থাকে)।” তখন কি
মনে হয় আপনার? মনে হয়
না একটা ভিন্ন কল্পনার জগতের কথা? যেই জগতের কথা আমরা ভাবি না। ভাবতে গেলে অস্পষ্ট একটা
পৃথিবীর ছবি আমরা দেখতে পাই। চিত্রকলার ভাষায় তারে কি কয়? আমি চিত্রকলা বুঝি না। আমি বুঝি একটা অধিবাস্তব পৃথিবী, যা আমাদের চারপাশ ঘিরে রেখেছে সেই ছবি এঁকেছেন রাজীব। আর সাথে বলেছেন সেই
পৃথিবীর গল্প।
এমন না যে রমিজ ইতিহাসের হাস্যকর
কল্পনা আর চলমান পৃথিবীর অধিবাস্তব গল্পেই জীবন যাপন করে। সে অধিকতর বাস্তবেও
বসবাস করে। যেমন রমিজ বলে, ‘হাতিরঝিল হাতিদের কাছে কেমন, তা রমিজ জানে
না’। আপনি জানেন? আপনার কি একটা
লেজ আছে? যেইটা বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখেন? নাই তো! দেখুন তো আছে কি না। আপনার সহপাঠি, সহকর্মী বা
বন্ধুর প্রশংসাই তো করেন তার সামনে। আর আড়ালে? তাকে যে ঈর্ষা বা ঘৃণাটা করেন সেইটা কি আপনার একটা
লেজ না? আমার
এই যুক্তি আপনার পছন্দ নাও হৈতে পারে। আদতে পছন্দ হইতেই হবে এমন কোনও কথাও না।
কিন্তু দেখেন এইভাবে আপনার ভেতর যে মানবিকতাবোধ আছে, তার আড়ালে তো একটা পশুত্বও আছে। সেই
পশুত্বকে যদি একটা হাতি ভাবতে চাই তবে খুব বেশী কি অপরাধ হবে? আপনার পশুটার
চাওয়াগুলোও তো পশুটার মতো বিশাল! তাই বলে এই ছবি দৈত্য এঁকে ফেলছে। বুঝলেন মশাই! সেই ছবিটা কেমন? ‘রমিজ যেভাবে
হাতি ভাবে। এমন না যে সে প্রতিদিন হাতি ভাবে। তবে ভাবা হাতির ২টা লেজ থাকবে, ২টা শুঁড়। ১টা
লেজ এবং ১টা শুঁড় রমিজের নিজের। এগুলো সে বালিশের নিচে রাখে’ ছবিটা
এমন।
''পাখিদের ছায়া ভিজে গেলে এরোপ্লেন তৈরি হয়''
উত্তরমুছুন