বুধবার, ১৫ মে, ২০১৩

“সাংবাদিকতা, একটা ব্যবসার জায়গা হৈলেও এইটা আদতে কোনও ব্যবসা না।”

at বুধবার, মে ১৫, ২০১৩  |  No comments



১৯৬৯ সালে জন্ম নেয়া ডেনিস টানোভিচ একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, একই সাথে সে পড়াশোনা করছে মিউজিক স্কুলেও। এর আগেও সে তোমার প্রেমিকা তোমারে ডাকে নামে ছোট সিনামা বানাইছে। জীবন কাটায় পুরাই ডকুমেন্টারি সিনামার পরিচালক হিসেবে। গেল বছর (২০০১) সে এই ছবি বানানোর পর কানে গোল্ডেন পাম, গোল্ডেন গ্লোব এ্যাওয়ার্ডও সে পাইছে। ব্যক্তিজীবনে কিছুটা রগচটে হলেও বসনিয়ান চলচ্চিত্রকার ডেনিস টানোভিচ যুদ্ধ নিয়াও মজা করতে ভালোবাসে। সিনামারে সে টাকা কামানোর মেশিন মনে করে না। তার প্রথম ফিচার ফিল্ম নো ম্যানস ল্যান্ড কেবল অস্কারই জিতছে না বিশ্বজুড়েই পাইছে তুমুল প্রশংসা। অস্কার নমিনেশন পাওয়ার পর পল ফিশ্চার তার লগে এইসব কথাবার্তা কইছে। 

প্রশ্ন : তোমার ছবি খুবই মজার, এত কঠিন ও অপ্রত্যাশিত বিষয় তুমি কইত্থে পাও?
উত্তর : আমরা বসনিয়ানরা হইতাছি অরিজিনাল মজা করার মানুস। আমগো জন্মই মজা করার জায়গায়। আমার মনে হয় আমি এইটা দিয়াই কিছু করবার পারমু। কিন্তু হিউমার কিন্তু তোমারে অনেক দূর থেকে বিষয়টা বইলা দেয়। আর তাই এইসব যুদ্ধের সিনেমার মধ্যেও তুমি কিছু হাসতে পারতেছো। এইটারে আমগো গোপন অস্ত্র কইতে পারো। তাই আমি মনে করি কেন আমি সিরিয়াস বিষয় নিয়া একটু মজা করবো না? এই ভাবনাটাই আমারে অনেক কিছু সহজ করে দেয়। আর তুমি যদি যুদ্ধ নিয়া সিনেমা বানাইতে যাও, তাইলে যেহেতু এইটা অনেকে দেখতেই যাইবো না তাইলে এইটাই কি ভালো না?
প্রশ্ন :আচ্ছা, এইডা বানাইতে কি তোমার খুব পরিশ্রম হইছিলো?
উত্তর : না। এইটা খুব আন্তরিক জায়গা থেইক্যা আমরা বানাইছিলাম। শুটিং এর ৩৬ দিনের মধ্যে দশ দিনই প্রচুর বৃষ্টি ছিলো। কোনও কোনও দিন আমরা স্যুটিংই করতে পারিনাই।
প্রশ্ন : আমরা দেখলাম যে এই ছবিতে প্রচুর প্রোডাকশন হাউজ আছে। যারা সবতে মিইল্যা এই সিনামা বানাইছে।
উত্তর : তারা প্রত্যেকেই সিনামাটা পছন্দ করছে। মজার বিষয় এইটা কিন্তু খুব দীর্ঘ কোনও প্রসেস ছিলো না। ছয় মাসের মধ্যে সব কিছু হইয়া গেছে। এইটা অকল্পনীয়। আমি স্ক্রিপ্ট লেইখ্যা, প্রডাকশন হাউজরে কইলাম এইটা একটা ভালো স্ক্রিপ্ট, তোমরা দেখতে পারো। তিনদিন পরে তারা আমারে ডাকলো, আর কইলো তাগো এই স্ক্রিপ্ট পছন্দ হইছে। তারা এইটা নিয়া একটা চুক্তিও করতে চাইলো। সবাই একই প্রসেসের মধ্যে দিয় গেলো। দেখলাম সবাই স্ক্রিপ্টটা পছন্দ করতেছে। (স্ক্রিপ্ট যখন লেখা হয় তখন তানোভিচ প্যারিসে থাকে। সে তখন মূল বিষয় থেইক্যা বহু দূরে। তার তো জন্ম আগের যোগোস্লাভিয়ায়। কিন্তু সারাজেভো থেইক্যা সে যখন ১৯৯৪ সালে বেলজিয়ামে সিনামা নিয়া পড়তে যায়, তখন তার বয়স ২৪
প্রশ্ন : তুমি যখন শুরু করছিলা, তখন তুমি ডকুমেন্টারির মতো কইরা শুরু করছিলা। কি মনে কইরা তুমি এইটা করছিলা? তোমার কখন মনে হইলো যে, যুদ্ধের বিষয় তোমার ফিচার ফিল্মের জন্য একটা ভালো সাবজেক্ট?
উত্তর : যুদ্ধ আসলে কখনোই ফিচার ফিল্মের জন্য ভালো বিষয় না। আমি পরিস্কার কইরা কইতেছি, আমার কখনোই মনে হইতো না বিষয় একটা বড় কথা, আমার মনে হইতো তুমি সাবজেক্টটারে কেমনে ট্রিট করতেছো তাই বড়। আমি এইখানে গতকালই এক সাংবাদিকের লগে কথা কইতেছিলাম। তারে কইলাম, এই সুইমিং পুলটারে দেখো। একজন ভালো সিনামাওয়ালা এই সুইমিং পুল লইয়াও এক থেকে দেড় ঘন্টার একটা সিনামা বানাইয়া ফেলতে পারে। যদি সে জানে যে, কেমনে কি করতে হইবো। আমি আবারো কইতেছি, এইটা কোনও বিষয়ই ছিলো না। শত শত ছবি যুদ্ধ আর প্রেম লইয়া, কিন্তু আমরা কয়টারে মনে রাখি? আমরা মনে রাখি অল্প কায়টারেই।  তাই কই, যু্দ্ধও ভালো বিষয় হইতে পারে যদি তুমি এইটারে ঠিকমতো দেখাইতে পারো আর তোমার নতুন কিছু কওয়ার থাকে। আমি আর এমন কোনো সিনামা বানামুনা, যেইখানে প্রথম বিশ মিনিটের মধ্যে ২০০ তরুণ সৈন্য মইরা যায়।


প্রশ্ন : সেভিং প্রাইভেট রাইন কিন্তু অনেক মানুষ পছন্দ করছে।
উত্তর : আমি কিন্তু নাম ধইরা কোনও সিনামার কথা কই নাই।
প্রশ্ন : ঐটাতেও কিন্তু বিশ মিনিটের মধ্যেই এমন ঘটনা ঘটে।
উত্তর : তো কি হইছে? প্রথম বিশ মিনিটের মধ্যে এক প্লাটুন কমান্ডো মারা গেছে বইলা?
প্রশ্ন : এমন কোনও যুদ্ধের সিনেমা কি তোমগোরে অনুপ্রাণিত করছিলো?
উত্তর : আমার মনে হয় প্রত্যেক সিনেমাই তোমারে একই পদ্ধিতেত অনুপ্রাণিত করবার পারে। এমন কি একটা জঘণ্য সিনেমাও তোমারে অনুপ্রাণিত করবার পারে। যেমন ঐটা দেইখ্যা তুমি ভাবতে পারো, অন্তত এমন সিনামা আমি বানামু না। আমার মনে হইলো সে এইখানে, ঐখানে ভুল করছে। এইসব দেইখ্যা তোমার মনে হইতে পারে তুমি তার চেয়ে ভালো একটা সিনামা বানাবা। কিন্তু তুমি যদি জিগাও ঠিক কোন আমিরিকান সিনামা সত্যি সত্যি আমার পছন্দ। তাইলে আমি কমু ‌ডিয়ার হান্টারর কথা। অন্তত আমার কাছে এইটাই সেরা।
প্রশ্ন : এমন কোনও সিনামাওয়ালা আছে যে তারে দেইখ্যা তুমি সিদ্ধান্ত নিছো তুমিও সিনামাওয়ালা হৈবা?
উত্তর : সিনামাওয়ালাদের নিয়া আমার বড় কোনও মন্তব্য নাই। আমার ভুল বুইঝো না। এইটা কিন্তু ছবি আঁকা চিত্রশিল্পীদের মতো না। তারা ৫০টা ছবি আইক্যা একটা দেখায়। কিন্তু সিনামাওয়ালারা তা করে না। তারা খুব জটিল, তারা  তাদের জঘন্য কাজটাও দেখাও, সেরাটাও দেখায়। তাই আমি কইতে পারুম না যে অমুক সিনামাওয়ালা তার জীবনে জঘন্য কোনও সিনামা বানায় নাই।
প্রশ্ন : তোমার কি টাকা পয়সা নিয়া সমস্যা হয় না?
উত্তর : দেখো, টাকা ছাড়া কিছুই হয় না।  তুমিতো জানোই, একটা সিনামা যখন বানানো হয়, তখন কম করে হইলেও সাড়ে ৩শ মানুষ সেইখানে কাজ করে। একটা মানুষ যদি তোমার সিনামার লগে যোগ হয়, তাইলে সিনামার লগেও কিছুটা যোগ হয়। যেমন তুমি যদি ভুল মিউজিক চুজ করো, তাইলে তোমার সিনামাও কিন্তু একটা ভুল করলো।  তুমি যদি ভুল অভিনয়শিল্পী চুজ করো তাইলে কিন্তু তোমার ছবির এ্যাক্টিংও ভুল হইতে যাইতেছে। তুমি যদি একজন এক নম্বর ক্যামেরা পারসন না লইয়া দুই নম্বর মানুষ লও, তাইলে তোমার সিনামার কাজও কিন্তু এমনই হইবো। এইটা তো তুমি জানোই যে এইটা কেমন।

প্রশ্ন  : কিন্তু তুমি যখন কম বাজেটে সিনামা বানাও...
উত্তর: কম টাকায় ছবির কথা কেন আসতেছে? আমার যখন যা প্রয়োজন আমি তখন তাই নিই।
প্রশ্ন : কিন্তু এইটা নিশ্চয়ই ৮০ মিলিয়ন না?
উত্তর : তোমার কি মনে হয় ৮০ মিলিয়নে একটা ভালো সিনামা হয়? তুমি আমারে দেখাও এই বছর (২০০২) হলিউডে এই টাকায় কি কি ভালো ছবি হইছে।
প্রশ্ন : তারপরও কি টাকার প্রশ্নটা আসে না?
উত্তর : আসে। কিন্তু তুমি এমন একটা সুন্দর ছবির কথা কও তো যা এই বছর হলিউড থেকে বাইর হইছে?
প্রশ্ন : স্রেক।
উত্তর : ও হ্যা। 
প্রশ্ন : ভালোই তো
উত্তর : হ্যা, আমার তো পছন্দই হয়
প্রশ্ন : মোলিন রোফ?
উত্তর : তুমি যদি যে কোনও মিউজিক্যাল সিনামার লগে এইটারে তুলনা করো, এইটারে তোমার জঘন্যও মনে হইতে পারে। মানে আমি কইতে চাইতেছি যে শুধুমাত্র মিউজিক্যাল হইলে এইটা খারাপ না। কিন্তু তুমি তো দুইটা  জঘন্য পদ্ধতির ভেতর দিয়া সিনামা বানাও। যার মধ্যে এক নম্বর হইলো তোমার কিছু বলার তা তুমি সিনেমার মধ্যে দিয়া বলবা। দুই নম্বর হইলো, তুমি মানুষরে বিনোদন দিবা। এখন কথা হইতেছে তুমি এর বাইরে কি কিছু করতেছো কি না? যদি বলো হ্যা কিছু করতেছি, তাইলে ঐসব হৈলো শুধুই নামকা ওয়াস্তের সিনামা। তারা বলে এইটা দিয়া টাকা কামানো যায়। টাকাই যদি তোমার এত কামাইতে মন চায়, তাইলে তুমি ওয়াল স্ট্রিট যাও। ঐখানে টাকা কামানোর সুবন্দোবস্তো আছে। অন্তত সিনামা টাকা কামানোর মেশিন না। তুমি কখনোই কেবল টাকা কামানোর জন্য সিনামা বানাইতে পারো না।  তুমি কখনো একটা শান্ত পৃথিবীর সিনামা বানাইতে পারো না। তুমি গরম ভাজা মুরগীর মতো সিনামা বানাইতে পারো না। কারন টাকাই সব কিছু না।
প্রশ্ন : বেশ।  তাইলে তারা তোমারে টাকা দেয় কি এইটা দিয়া দীর্ঘদিন টাকা কামানোর জন্য?
উত্তর : কে কইলো তোমারে?
প্রশ্ন : তোমার কথামতো কি তাইলে আমি যদি তোমারে সিনামা বানানোর জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার দেই তাইলে আমি কি এইখান থেইক্যা লাভ আশা করবো না?
উত্তর : আমি কখনোই কই নাই যে আমি ব্যবসা করার জন্য সিনামা বানাই। আমি এইটার জন্য দুঃখিত। আমি কখনোই মনে করি না সিনামা একটা জ্যকপট মেশিন না। তুমি যদি ব্যবসার জন্য সিনামা বানাইতে চাও তবে বানাও। কিন্তু আমি তার জন্য না।
প্রশ্ন : তাইলে তুমি কি কইতে চাইতেছো যে, তোমার ছবিতে টাকা ফেরত আনার ব্যাপারে কোনও প্রেসার নাই?
উত্তর : তুমি কি এই উত্তর আমার কোনও সিনামায় দেখছো?
প্রশ্ন : হ্যা। আমি মনে হয় দেখছি।
উত্তর : তুমি কি জানো আমি কেন সিনামা বানাই? তোমার কি মনে হয় আমি টাকার জন্য সিনামা বানাই?
প্রশ্ন: মনে হয় না।
উত্তর : মনে হয় না। বিশ্বাস করো আর নাই করো, আমি টাকার জন্য সিনামা বানাই না। আমি যদি টাকার পেছনে এতই ছুটতাম, তাইলে আমি ওয়াল স্ট্রিটে যাইতাম বা কোনও ব্যাংকে যাইতাম। ঐখানে টাকা কামানোর যথেষ্ঠ পদ্ধতি আছে।
প্রশ্ন: আচ্ছা আমরা বিষয়টা বদলাই। আমরা তোমার কাজের প্রসঙ্গে আসি। তোমার ছবিতে আমরা দারুণ দারুণ অভিনয়শিল্পী দেখছি। তাদের নিতে বা তাদের যোগার করতে তোমার কেমন হ্যাপা পোহাইতে হইছে?
উত্তর : আমার সিনেমায় অধিকাংশ অভিনয়শিল্পীই পরিচিত। তারা সবাই বলতে গেলে যুগোস্লাভিয়ার তারকা। আমি খালি তাদের থেকে সেরাদের বেছে তার কাজের জায়গাটা ঠিক করে দিছি। এছাড়া আমি কিন্তু ফেলিনির  মতো কাজও পছন্দ করি। তারা কয়েকজন রাস্তা থেইক্যা উইঠ্যা আসুক তাতে আমার সমস্যা নাই। কিন্তু কাজ ভালো হইলে আমি তাগোরে কমু দুর্দান্ত।
প্রশ্ন : সাইমন কালো সম্পর্কে তোমার বক্তব্য কি?
উত্তর : সত্যি কথা কি, সাইমন কালোই একমাত্র অভিনেতা যারে আমি নিজে কাস্ট করি নাই। তারা আমারে জিগাইলো, তারা (প্রডিউসার) আমারে জিগাইলো তুমি কি সাইমন কালোরে তোমার ছবিতে চাও? আমি কইলাম হ। আর সে জয়েন করলো।  আমাদের চিন্তার পার্থক্য ছিলো। সে তার মতো করতে চাইছিলো। কিন্তু আমি তা চাই নাই। যদি তার মতোই হৈতো তাইলে কি হইতো জানিনা। কিন্তু এইটা ভালো কাজ হইছে।
প্রশ্ন : এই সিনেমার মধ্যে কিছু কথা আছে যুদ্ধের সময় মিডিয়ার আচরণ প্রসঙ্গে। এইগুলো কি তুমি ইচ্ছা কইরাই করছো?
উত্তর : হা হা হা। এইটা একটা সমস্যা বটে। কারণ তুমি তোমার ব্যবসা, চাকরি এইসবের মতো কইরা চিন্তা করবা।
প্রশ্ন : তুমি কি কইতে চাইতেছো?
উত্তর : সাংবাদিকতা, একটা ব্যবসার জায়গা হৈলেও এইটা আদতে কোনও ব্যবসা না।
প্রশ্ন : তার মানে কি দাঁড়াইতেছে?
উত্তর : প্রথমেই আমি বইলা রাখি, তুমি আমার সাথে সব কথায় একমত নাও হৈতে পারো। ধরো ঈশ্বর নামের কেউ একজন আছে, যদিও তার অস্তিত্ব নাই। এবং আমরাও সবাই তার মতোই গৌন। তাই তুমি সেই জিনিসটাই করো না, যার কোনও কেন্দ্র নাই। তুমি সব সময়ই একটা কেন্দ্রের মধ্যে ঘুরপাক খাইতে থাকো, কারন তুমি কেন্দ্রে বন্দী। তো তুমি যখন কেন্দ্রকেই মূল মনে করো, তখন তো তোমার একটা যাত্রার পথ তৈরি হয়। আর এইসব যাত্রার পথ তো শেষ পর্যন্ত যাই বলো না কেনো ঐ ব্যবসার কাছে গিয়াই শেষ হয়। আমরা তো ব্যবসা নিয়াই কথা কইতেছিলাম না! মাঝে মাঝে কিছু সত্য তোমার ক্ষতি করে দিবে। তাই, তুমি সব সময় সাংবাদিকতাকে ব্যবসা হিসেবে দেখতে পারো? আমি ভাবিনা তুমি ব্যবসার জন্য সাংবাদিকতা বেছে নিবা।
প্রশ্ন : আচ্ছা, আমি তোমারে নিশ্চিত করতেছি আমরা এইখানে ব্যবসা করতে আসি নি।
উত্তর : বেশ, তাইলে তুমি এইটারে একটা ভালো জায়গায়ই রাখতে চাও। তাইলে তুমি সাংবাদিকতাটা কেন করবা? কারণ, তোমার কিছু বলার ও করার আছে এইখানে, তাইতো! একই রকম আমিও মনে করি আমারো কিছু বলার আছে এবং প্রথমত তা সিনেমায়, এবং তা বিনোদনের মাধ্যমে হৈলেও হৈতে পারে। এর চেয়ে বেশী কিছু না।
প্রশ্ন : সার্বিয়ান সিনামার পেছনের কিছু শয়তানি ইতিহাস আছে, এইটাকে অনেকটা সাদা-মাটা সিনামার মতো।
উত্তর : হ্যা, সেইটা তুমি বানাইতে পারো, আমি পারি না।  যদি আমি বানাইতামই, তবে আমি এইখানে থাকতাম না।
প্রশ্ন : যেমন?
উত্তর : কারণ, তাইলে পাবলিক আমাকে অতিরিক্ত প্রচারমুখী বইলা গালি দিতো।  

প্রশ্ন : বেশ, এইটা তাইলে একটা আগ্রহের বিষয়। এইবার বলো, হলিউড যেইভাবে যুদ্ধরে দেখায় আর তুমি যেইভাবে যুদ্ধরে দেখাও এর মধ্যে পার্থক্য কি?
উত্তর : আমি কেমনে দেখাইছি? আমি দেখাইছি দুইজন মানুষ যারা প্রত্যেকেই মনে করে সে ঠিক পথে আছে। এইটা কি কোনও বৈপরিত্যের কথা বলে? তোমার কাছে এর বৈপরিত্য থাকতে পারে, কিন্তু সারা পৃথিবীর যে কোনও জায়গায়ই যাইবা সেইখানে দেখবা দুইটা পৃথক মানুষ পৃথক জায়গায় ঠিক।
প্রশ্ন : তাইলে তাদের কেউ এই সিনেমার নায়ক না?
উত্তর : বলতে পারো বাস্তবে তো নায়ক নাই। আমার মা একজন নায়ক, প্রতিদিন সে ২০ লিটার কইরা পানি আনতো সেই পানি দিয়া আমরা সব কিছু করতাম, অথবা আমরা যখন শিশু ছিলাম তখন তিনি প্রতিদিনই আমাদের পড়াইতেন। অথবা আমার বাবা আমাদের কাছে প্রতিদিনই একজন নায়ক হয়ে উঠতো, যখন সে টিভিতে দর্শকদের জন্য অনুষ্ঠান বানাইতো। আসলে যুদ্ধের সময় প্রত্যেকেই নায়ক। তাদের কাজটাই নায়কোচিত। তাইলে তুমি এইখানে কোন ধরনের হিরুইজম নাই বইলা মনে করতেছো? এইটা কেবল আমাদের কল্পনা সীমাবদ্ধতার ছবি। এইখানে কেউ গুলি করার জন্য আইসা লাফ দিয়া পড়ে নাই। এইটা তোমার বৃহৎ কল্পনার ক্যানভাস ছাড়া কিছুই না।
প্রশ্ন : সিনামায় কিন্তু জাতিসংঘকে বলতে গেলে কিছুটাও দায়ি করা হইছে।
উত্তর : এইখানে তো ঐ দুইজনের মধ্যে কে বেঁচে থাকবে এই দায়িত্ব নিয়াও তারা কাজটা ঠিকমতো করতে পারে নাই। আমি এইখানে একটা বিষয়ই দেখাইতে চাইছিলাম, যে যারা মাঠে থাকে এবং প্রাণ হারায় আর যারা বাড়িতে থাকে সপ্তাহ শেষে পরিবার নিয়া ঘুরতে যায় তাদের জীবনের মধ্যে পার্থক্য আছে।
প্রশ্ন : তাইলে এই সিনামা কি অসম যুদ্ধের কথাই স্মরণ করাইয়া দেয়ার জন্য?
উত্তর : একে অপরকে খুন করতেছি আমরা। কেন করতেছি? কাওরে কি খুন করার দরকার আছে? কেন যুদ্ধর মতো বিষয় নিয়া শুধু শুধু প্রতিযোগীতা। সবাই আসলে মানসিকভাবে অসুস্থ্য।
প্রশ্ন : তাইলে এই সময়টাকে তুমি কি ধরনের সময় কইতেছো?
উত্তর : প্রত্যেকটা মানুষই একেকটা মাইনের মতো, ফোটার অপেক্ষা করতেছে।
প্রশ্ন : তুমি কি তাইলে অপ্টিমিস্ট?
উত্তর : তাইতো মনে হয়
প্রশ্ন : তাইলে তোমার বিষয়ে কি ভাববো?
উত্তর : তোমারে কেমনে যে বুঝাই। তুমি চিন্তা করো, যেই মানুষটা নিউইয়র্কে ওসামা বিন লাদেনরে নিশ্চিন্তে হাটতে সাহায্য করতেছে। কিন্তু এইটা যদি সারাজেভোতে হইতো? তাইলে তুমি তারে যুদ্ধপরাধী মনে কইরা সরাসরি গুলি কইরা দিতে পারো। সারাজেভোতে এই রকম অনেক মানুষ আছে যারা যুদ্ধের কারণে এতিম। এমনকি তারা এই শহর ছাইরা যায়ও না। এইসব নারী ও শিশুরা শহরের পথে-ফুটপাতে রাত কাটায়। কারণ তারা যুদ্ধ থামাইতে পারে না। এই জায়গায় কিন্তু আমরা সবাই একই রকম। যুদ্ধের আগ্রাসন থেইক্যা বাঁচতে আর সুন্দরভাবে জীবন কাটাতে চায়। কিন্তু এই পথে যে তা সম্ভব না। যারা যুদ্ধাপরাধী, যাদের শাস্তি হওয়া উচিত তারা এখনো নিশ্চিন্তে ঘুইরা বেড়াইতেছে। বসনিয়ায় এই রকম প্রায় ৩৫ হাজার সৈন্য আছে, তারা লস এঞ্জেলসের চেয়েও ছোট্ট একটা ভূ-খন্ডে বাস করতেছে। আর তাদের না ধরার জন্য আমাদের কোন আক্ষেপ নাই।
উত্তর : এই সিনামাতো সারাজেভো ফিল্ম ফ্যাস্টিভ্যালেও দেখানো হইছে। তারা কি বলছে?
উত্তর : তারাতো খুবই ভালো কথা বলছে। কারণ, আমি মিথ্যা বলা পছন্দ করি না। যেমন তোমাকেও বলি না, তাদেরকেও না।  তোমাকে বুঝতে হবে, তুমি একটা সিনামা বানাইবা এইটা বিশ্বের যে কোনও ফ্যাস্টিভ্যালে বানাইবা এইটা যে কোনও ক্যাটাগরিরই হোক না কেন, এইটা সেরা হইতে হবে। যদি এইটা অন্যতম সেরা হয় তাইলে তুমি পুরস্কারও পাইবা। আর তাতে তোমার প্রতি প্রত্যাশা বাড়বে পাশাপাশি বাড়বে তোমার স্বপ্নের ক্যানভাস। তুমি আরো বৃহৎ স্বপ্ন পুরনের চিন্তা করবা! যাই হোক, তারা কি আমারে প্রেসিডেন্ট বানাইয়া দিতাছে নাকি?!
প্রশ্ন : একাডেমি পুরস্কার দিয়া?
উত্তর : ভালোই তো! (হাসি)
প্রশ্ন : তোমার কোন শ্রেণীর দর্শক পছন্দ? মানে কোন শ্রেণীর দর্শকদের লক্ষ্য কইরা তুমি সিনামা বানাও?
উত্তর : আমি মনে করি এই সিনামা কিছু জায়গায় অন্য ছবিগুলোর চাইতে আলাদা। আমি মনে করি এই সিনামা যদি একটি শিশু দেখে বা যে কেউ দেখুক যে কিনা বসনিয়া নিয়া কিছু জানে না, তারাও যেনো বসনিয়া নিয়া জাইন্যা যায়। আমি এই জায়গায় অন্য সব ছবির চাইতে এইটারে আলাদা মনে করি, এইটা মূলত মানসিক একটা বিষয়। আমি চাই এইটা দেইখ্যাই লোকে চিনুক, এইটা বসনিয়ার ছবি এবং তারা ছবিটা এনজয় করুক।
প্রশ্ন : আমেরিকারন দর্শকদের জন্য এইখানে তবে কি আছে?
উত্তর : আমি দর্শকদের আলাদা কইরা ভাবি না। এইটা ব্রাজিল হোক আর জাপান। আমি টেলুরাইড ফিল্ম ফ্যাস্টিভ্যালেও দেখছি মানুষ ছবিটা পছন্দ করছে। আমার মনে হয় সিনামার এইটা একটা বড় বিষয় যে, সবার কাছে সিনামাটা প্রিয় করা একটা কঠিন ব্যাপার। সত্যি কইতেছি, আমি এইটা নিয়া ভিত এবং একই সাথে চিন্তিত। আমি একটা ভালো সিনামা বানাইলাম আর এই সিনামা সারা দুনিয়ায় দেখলো। এইটা দিয়া আমি একটা বিষয় শিখলাম যে, আমি জাপান, আমেরিকা বা ফ্রান্সের দর্শকদের একটা সিনামা দিয়া হাসাইতে পারছি ও আমার কথাটাও বলতে পারছি। খোলাখুলি বলি, তাই বইলা তুমি ভাইব্যো না যে, এইটা বিশেষ কোনও কায়দা। আর আমার কথায়ও বিশ্বাস কইরো না। আসলে এই দুনিয়ার সবাই আমরা এক ও অভিন্য। আমি এমন কাউরে দেখিনাই যে এই ছবি দেইখ্যা হাসে নাই। আমি কইতে চাই এইটা একটা সিরিয়াস সিনামা কিন্তু এইটাতে বেশ ভালো মজার দৃশ্য আছে।
আমি জানি মানুষ যুদ্ধের ভয়াবহতার শিকার হয়েছেন, আবার এমনও আছে তারা সর্বস্বান্ত হয়েছেন। আমি নিজেও যুদ্ধের মাঝ দিয়ে গিয়েছি, আর তাই আমি চেষ্টা করেছি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে ছবিটা বানাতে। বলতে অসভ্যের মতো শোনায় যদিও তারপরও বলি, আমি আমার জেনারেশনকে আমাদের পৃথিবীটা কেমন তা দেখা শেখার জন্য চেষ্টা করেছিলাম। যেসব মানুষ ছবিটা দেখে ছবির ভেতরের ট্রাজেডিটা ধারণ করতে পারছে, তারা এক বিন্দু পরিমানও হাসে নি। অনুভূতির জায়গা থেকে তো আমরা প্রত্যেকেই আলাদা এবং স্বতন্ত্র। আসলে এইটা তো কিছুটা অ্যাবসার্ডও, যেমন কেউ তোমারে বললো ঐখানে সত্য নাই আর তার জন্যই সেটাই সত্য হয়ে যাবে এমন তো কিছু না। যাই হোক, আমরাতো এইটা সাত ডিসেম্বর দেখতেই পারবো।
আমি বাজে সময়ের গল্প পছন্দ করি। আমি যখন শিশু ছিলাম আমার মা তখন আমারে নিয়া সিনামা দেখতে যাইতো। আমি সব সময়ই নাটক দেখতে যাইতাম, ব্যালে দেখতে যাইতাম। আমি পিয়ানো বাজানোর কোর্স করেছি। বলতে পারো আমার পুরো জীবন শিল্পের মধ্যে। আমার বাবাও একজন লেখক ছিলেন।
প্রশ্ন : তাইলে তুমি গানে না গিয়া সিনামায় আসলা কেন?
উত্তর : আমি আসলে জানি না। বোধহয় আমি সিনামা ভালোবাসি বলেই। আমি ডকুমেন্টারি দিয়া সিনামা বানানো শুরু করছিলাম। কারণ আমি জানি, জীবন হইলো সবচেয়ে বড় চিত্রনাট্যকার, যার বাইরে যাওয়ার সাধ্য আমাদের নাই। জীবনের এই বিচিত্র চরিত্র  কোনো অংশেই সিনামার চেয়ে কম না। কেউ অবিশ্বাস করলেও না। আর যুদ্ধের প্রসঙ্গে তো নয়ই।
প্রশ্ন : তুমি কি হলিউডে সিনামা বানাবা?
উত্তর : এইটা অনেকটা প্রজেক্টের ওপর নির্ভর করে। আমার জন্য স্ক্রিপ্টই হইতেছে সবচেয়ে বড়, বলতে গেলে বাইবেলের মতোন। আমি জানি এইখানে কিন লোচ, মাইক লেইগ এর মতো ডিরেক্টররা আছেন। তাদের স্ক্রিপ্ট লাগে না। কিন্তু সব কিছু আবিষ্কার করে তারা। আমার জন্য ঐভাবে সম্ভব না, তাই আমার স্টোরিবোর্ড লাগবেই। কারণ, আমার কাছে স্যুটিং একটা টেকনিক্যাল বিষয়। আমার কাছে স্ক্রিপ্ট আসলেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্ক্রিপ্টে যদি বিনোদন আর ভালো কিছুর সমন্বয়টা থাকে, তাইলে আমি তারে ভালো স্ক্রিপ্টই বলবো। তাইলে কেন আমি করবো না?
আমি মনে করি সিনামা বানানো পৃথিবীর সবচে পূর্ণাঙ্গ কাজের একটা। এইখানে তোমাকে লেখক হইতে হইবো, রাজনীতিবিদ হইতে হইবো, ব্যবসায়ী হইতে হইবো, জীবনের রং দেখার ক্ষমতা থাকতে হইবো, তোমার জানতে হইবো কেমনে সিনামা হয়, কিভাবে কাটতে হয় তা জানতে হইবো, অভিনয়টা কি তাও জানতে হৈবো, মিউজিক তো বটেই। তারপরে না তুমি সিনামা বানাইবা। এইগুলো ছাড়া যেমন সম্ভব না, আর আমি কখনোই যেমন না জাইন্যা একটা অপেন হার্ট সার্জারি করতে যাবো না। তুমি চেষ্টা করতে পারো। তাতে রোগী মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই রকমভাবে না জেনে করায় প্রচুর সিনামা মারা যায়। প্রত্যেকেই মনে করে তারা সিনামাটা বানাইতে পারে। কিন্তু আসলে তারা কিস্যু পারে না। আমি এমন কইরা বলতেছি বইলা কিছু মনে কইরো না। আমি এই বিষয় নিয়া বিগত ১০ বছর যাবৎ প্রতিদিন চর্চা করতেছি বলেই এই কথা বললাম। একজন সিনামা নির্মাতা কেবল লাল কার্পেটে হাঁটার জন্য না, এইটা বুঝতে হবে। এইটা একটা বাস করার জায়গা। এইটা কোনও চাকরি না, এইটা ২৪ ঘন্টার একটা জীবন।


Share
About the Author

Write admin description here..

0 মন্তব্য(গুলি):

এই সাইটের যে কোনও লেখা যে কেউ অনলাইনে ব্যবহার করতে পারবে। তবে লেখকের নাম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।

Blogger template Proudly Powered by Blogger. Arranged By: এতক্ষণে অরিন্দম