শুক্রবার, ২৯ জুলাই, ২০১১

ফেস বাই ফেস : নাগরিক প্রতিরূপের ভিজ্যুয়্যাল

at শুক্রবার, জুলাই ২৯, ২০১১  |  No comments

মাহবুব মোর্শেদের সাথে আমার পরিচয় ছিলো বেশ পূর্বে থেকেই। তবে সেটা ব্যক্তিগত নয়। তার দু-একটা লেখা পড়ে আর আর তার সম সাময়িক অন্য গল্পকারদের কাছে তাঁর নাম শুনে। তিনি ভালো গল্প লিখেন, এই কথা আমি তাঁদের কাছে বিভিন্ন সময় কথার ফাঁকে ফাঁকে কেউ হয়তো অন্যমনস্কভাবে বলে ফেলেছেন তাঁর নাম। আমার সেটা মনে ছিলো। তার কিছু কারণ হলো তার লেখার সাথে লোকজন তার ব্যক্তির মেলাতে চাওয়ায় সেটা মেলে না। সেটা নানান কারণেই। সে প্রসঙ্গ বলতে গেলে কথার দিক উল্টো ঘুরতে শুরু করবে। আমার এই চেনা-জানার জগতে একদিন হঠাৎ করে আড্ডার ফাঁকে উপস্থাপন করলো একটা মলাটহীন বই। গল্পগ্রন্থ। মাহবুব মোর্শেদ এর ব্যক্তিগত বসন্তদিনে। ঐ রাতেই চোখ মেলে দেখলাম আমাদের কালের এক সাহসী গল্পকারের ভাব ও ভাষার খেলোয়ারকে। আমি মাহবুব মোর্শেদকে ভাব ও ভাষার সাহসী খেলোয়ারই বলবো। কারণ, আমি ব্যক্তিগত বসন্তদিনের যেই মাহবুব মোর্শেদকে চিনি সেই মাহবুব মোর্শেদের গল্প বলার ভাষা সাবলিল। এই সাবলিল ভাষায় অনেকেই লিখতে চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই চেষ্টা আর ভাষার সাবলিলতা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে না পেড়ে আত্মহত্যা করে বর্ণে গাঁথা বাক্যমালায়। আমার কাছে মাহবুব মোর্শেদ মূলত সাহসী তাঁর জিসম গল্পের জন্যে। আমার মনে পড়ে জিসম গল্পের প্রসঙ্গে কোনও এক আড্ডা বা বৈঠকিতে আহমাদ মোস্তফা কামাল স্মৃতিচারণ করেছিলেন (যদি আমার স্মৃতি আমার সাথে প্রতারণা না করে) এই রকম যে, ‘একদিন মাহবুবের সাথে আজিজে দেখা। তাকে জিজ্ঞেস করলাম কি লিখলে? সে তখন একটা গল্প শোনালো। গল্পটার নাম জিসম। আমাদের হাতের কাছেই তখন পাওয়া যায় বলিউডের সাম্প্রতিক মুক্তিপাওয়া ছবি জিসম এর ডিভিডি কপি। জন আব্রাহাম আর মল্লিকা শেরাওয়াত এর ছবিটি একটা হটকেক এর মতো ছবি। অনেক শরীরী। গল্প শোনার পর আমি মাহবুব কে বললাম, তোমার গল্প পড়ার পর তো মনে হতে পারে যে তুমি হয়তো এই জগৎটার সাথে প্রত্যক্ষ জড়িত। অথবা খুব বেশি পরিচিত। যাতে তোমার ব্যক্তিত্বের উপর অনেকের ভুল ধারণাও হতে পারে। এই কথা বলার পর মাহবুব মোর্শেদ শুধু হাসলেন। আর বললেন যে, যদি লোকে কিছু ভাবে তো আমার কি কিছু করার নাই। এই হৈলো মাহবুব মোর্শেদ এর লেখার খুব সাধারণ একটা প্রতিক্রিয়া। কিন্তু আমি ফেস বাই ফেস এর মাহবুব মোর্শেদ কে সেই জিসম এর কারণেও সাহসীই বলবো। জিসম এর মতো যৌনগন্ধি বা মানুষের অবদমিত আকাঙ্খার অপ্রাতিষ্ঠানিক রূপটি একটা গল্পের মাঝ দিয়ে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে বাঙলাদেশের মানুষ কাছাকাছি জীবনের যৌনতার রূপ তটুকু জেনেছে তা আমার জানা নেই। তবে মাহবুব মোর্শেদ তা ঠিকই দেখাতে পেরেছেন।
তাকে একই কারণে সাহসী বলছি এই কারণে যে, যেই দেশে একটা মানুষ তার অনাকাঙ্খিত যৌণ অভিজ্ঞতার কথা বলতে গেলেই তা কাঠমোল্লা আর লোক দেখানো প্রগতিশীলদের কু-নজরে পরে যায় সেখানে মাহবুব মোর্শেদ তার জিসম গল্পের মতই সাহসী তার প্রথম উপন্যাস ফেস বাই ফেস এ-ও।
ফেস বাই ফেস সম্পূর্ণ নাগরিক একটি উপন্যাস। আরো সহজ ভাষায় বলতে গেলে একটি সমান্তরাল জীবনের কথ্য ভিজ্যুয়াল। প্রকৃত অর্থে আমার এটাকে ভিজ্যুয়ালই মনে হয়েছে। এই ভিজ্যুয়ালের মূল চরিত্র শুভ। যে কিনা একটা বায়িং হাউজে কাজ করে। আর এই সময়টায় আমাদের চারপাশের জীবন যেহেতু ধীরে ধীরে ছোট হয়ে হয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে ধাবিত হয়ে যাচ্ছে, সেখানে মাহবুব মোর্শেদের এই কেন্দ্রীয় চরিত্রটিও সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুকের মাধ্যমে অন্য একটা জীবন তৈরি করে। যা বাংলাদেশের নাগরিক জীবনের স্বাভাবিক একটা অংশে এখন রূপান্তরিত। পার্শ্ব চরিত্র হিসেবে এসেছে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু তিন্নি। নওরোজ ভাই, রওনক ভাবি ও অন্যান্য আরো কয়েকজন। যারা প্রত্যেকেই আমাদের ভার্চুয়াল জগতের লুক্কায়িত বা প্রকাশিত নানামুখি সাহসী ও ভিরু মানুষ। মাহবুব মোর্শেদ এর এই কথ্য ভিজ্যুয়েল এক কথায় আমার কাছে মনে হয়েছে আধুনিক। এবং পরিচ্ছন্ন। যদিও গল্পের কিছু ফারাক থেকে যায় একজন মনযোগী পাঠক স্পষ্ট ধরতে পারেন সেই ফারাকগুলি। কিন্তু তারপরও এইগুলো সাধারণ বিষয়। শুভ’র চরিত্রের ভিতর অস্তিমাংশময় মিশে আছে বিভ্রান্তী। সে তার কাঙ্খিত মানবী তিন্নিকে কে চিনতে পারে না। বুঝতে পারে না সে গল্পের শেষ পর্যন্ত। অস্তিত্বের প্রশ্ন যখন আসে তখন তিন্নি নিজেই উন্মোচন করে সেই রহস্য। তিন্নির বান্ধবী সূপর্ণা ও তিন্নি। মাঝামাঝি শুভ দ্বান্দ্বিক পৃথিবী ক্ষণে ক্ষণে দূরে চলে যায় আবার কাছে আসে তা বর্তমান সময়ের মধ্যবিত্ত সমাজের একটি মূল্যবোধকে ধরে রাখে বলেই হয়তো এরকম করে। কিন্তু জীবনের এই সময়ে এসে বাংলাদেশ নামক ভূ-খন্ডের মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত জীবন এই মূল্যবোধগুলো অনেক আগেই বিষর্জন দিয়েছে তা ধরা পড়ে না। তাই শুভ তার প্রেম বা যৌন জীবনের কোনও নিশ্চয়তা সে কারও কাছ থেকে পায় না। না তিন্নি না সূপর্ণা। কিন্তু তিন্নি আর সূপর্ণার মাঝ থেকে শুভকে অতিক্রম করে সেই সত্যকে তুলে আনেন নওরোজ ভাই। যার স্ত্রী (রওনক ভাবি)র সাথে শুভ অদৃশ্য প্রেম তৈরি হতে সময় প্রয়োজন হয় না। যা রূপান্তরিত হয় সেই মনো শাং-রি-লা’য়। সেখানেই শুভ আরো একটি চারিত্রিক দিক উন্মোচিত হয়। ক্ষুধা। যৌণক্ষুধা। যা ফ্রয়েডিয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটি পুরুষ শিশুও সাথে করে জন্মায়। এবং তাকে পরিচালিত করে সেই যৌন চেতনাই। তিন্নি আর সূপর্ণার সর্ম্পকটাও আমাদের সাহিত্যে নতুন। এই ধরণের চরিত্র নির্মাণের জন্যই আমি মাহবুব মোর্শেদকে সাহসী বলি। যা তিনি পূর্বেও দেখিয়েছন এবং আশাকরি ভবিষ্যতে আরও ভালো করবেন। যেই কথা বলছিলাম। মাহবুব মোর্শেদের এই কথ্য ভিজ্যুয়্যালের শুভকেও সেই যৌণবোধই চালিত করে। যা প্রাগৈতিহাসিকে ভিখুকে পরিচালিত করেছিলো পাঁচিকে নিয়ে পালিয়ে যাবার। যার পরিণতি দেখি তিন্নি দিকে জ্বরাক্রান্ত শুভর বাড়িয়ে দেয়া ঠোঁটের জন্যই। মনে হয় শুভ তো ফেসবুক, সাবিহা মেহনাজ সুপ্তি, তিন্নি, রওনক, সুপর্ণা আর আরো যে সকল বিষয়ের সাথে শুভ সম্পৃক্ত সবগুলোরই একটা যৌনজীবনের পরিণতির কথা ভেবেই। তবে এই কথ্য ভিজ্যুয়্যাল কোনও যৌণ সুরসুরিমূলক ভিজ্যুয়াল নয়। সর্বোপরি যাপিত জীবনের সরল আখ্যান।

(মাহবুব মোর্শেদ এর প্রথম উপন্যাস ফেস বাই ফেস উপন্যাস নিয়ে শূন্যপুরাণ এ প্রকাশিত গদ্য)

Share
Posted by eliuskomol
About the Author

Write admin description here..

0 মন্তব্য(গুলি):

এই সাইটের যে কোনও লেখা যে কেউ অনলাইনে ব্যবহার করতে পারবে। তবে লেখকের নাম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক।

Blogger template Proudly Powered by Blogger. Arranged By: এতক্ষণে অরিন্দম